তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে বিতর্কের জন্ম নিয়েছে। তিনি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “মুজিববাদী বামদের ক্ষমা নেই।” এই বাক্যটিকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই এটিকে ‘মৌচাকে ঢিল’ বলে অভিহিত করছেন।
বাংলাদেশে আদর্শিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের দীর্ঘ ইতিহাসে বাম ঘরানার অবস্থান বহুবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাকশাল গঠন এবং তার আগে-পরে সিপিবি ও মনি সিংয়ের বামধারার প্রভাব সংবিধানের চার মূলনীতির রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তথ্যমতে, শেখ মুজিব সেই সময় কমিউনিস্টদের ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বাংলাদেশি বাম রাজনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকে রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে বিদেশি অর্থে এনজিও চালানো শুরু করেন। এই শ্রেণির মধ্যে অনেকেই এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে সক্রিয় রয়েছেন। এদের কেউ কেউ আবার পশ্চিমা কূটনীতিকদের মাধ্যমে নির্বাচন পেছানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাসে এই গোষ্ঠীকে ‘থার্টি সিক্সথ ডিভিশন’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যারা অতীতে ছাত্র আন্দোলনের সময় ‘পতিত হাসিনার’ পক্ষে দালালি করেছে। তারা একদিকে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও পরিবেশ নিয়ে মুখে কথা বললেও অন্যদিকে শাসকের স্বার্থে কাজ করেছে। এই গোষ্ঠী পাকিস্তানপন্থিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার পরিবর্তে ইনিয়ে-বিনিয়ে তাদের অবস্থানকে বৈধতা দিতে চেয়েছে বলেও মাহফুজের অভিযোগ।
তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্যের পর কিছু মহল তার অতীত জীবনকে টেনে এনে আক্রমণ করেছে। সামাজিক মাধ্যমে তার মাদরাসা পড়ুয়া জীবন, পাঞ্জাবি পরা ছবি ছড়িয়ে দিয়ে তাকে শিবির সংশ্লিষ্ট বলে প্রচার চালানো হয়। কিন্তু মাহফুজ আলম এই আলোচনার মধ্যেও নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছেন।
এদিকে, দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন নিয়ে বিভাজন স্পষ্ট। একদিকে, পশ্চিমা কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে নির্বাচন পেছানোর উদ্যোগ চলছে, অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীল ও নির্বাচিত সরকারের দাবি জানাচ্ছেন। রাজনৈতিক বাস্তবতায়, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠাই বিদেশি বিনিয়োগ ও আস্থার পূর্বশর্ত হয়ে উঠেছে।
বাম রাজনীতির নামে যারা আজ পশ্চিমা দাতা ও দিল্লিপ্রেমী এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত, তারা একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারে অংশ নিচ্ছেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক সংস্কারের নামে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এদের সুরে মিলে ইসলামী দলগুলোর কেউ কেউ বিএনপিকে ‘নির্বাচনের জন্য পাগল’ বলে উপহাস করছেন, আবার কেউ কেউ নির্বাচনের সময়সূচি নিয়েও দ্বিমত পোষণ করছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরেও জামায়াতে ইসলামীর দ্বৈত ভূমিকা সামনে এসেছে। তারা কখনও নির্বাচন চায়, কখনও সংস্কার চায়, আবার কখনও সরকার নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে। অভিযোগ উঠেছে, জামায়াতপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশাসনে পুনর্বাসনে বাম চেতনার উপদেষ্টারা সহায়তা করছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসলামপন্থা কখনোই অগ্রাহ্য হয়নি, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা বা তথাকথিত বাম চেতনা কখনোই জনগণের বিস্তৃত সমর্থন পায়নি। দিল্লিপ্রেমী বামদের এখন এনজিও ও ‘সংস্কার’ নামক রাজনৈতিক ব্যবসা ছাড়া আর কোনো শক্তি নেই। তাদের প্রভাবশালী অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করায় মাহফুজ আলমের বক্তব্যে এই তীব্র প্রতিক্রিয়া।
এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক সংকট শুধু নির্বাচনী নয়, আদর্শিকও বটে। আর এই আদর্শিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশে বাম ধারার ভূমিকা, তাদের নৈতিক অবস্থান, এবং ক্ষমতা অর্জনের কৌশল। মাহফুজ আলম এই সংঘাতকে সামনে এনে রাজনৈতিক বিতর্ককে নতুন করে শাণিত করেছেন, যা আগামী দিনে অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন এবং জাতীয় রাজনীতির গতিপথে প্রভাব ফেলতে পারে।