বাংলা সংগীতের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নিভে গেল। সংগীতশিল্পী, সুরকার, সংগীত সংগ্রাহক, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী আজ শনিবার (১০ মে) সকালে রাজধানীর বনানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। শ্বাসকষ্টজনিত কারণে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
তার মৃত্যুর খবর জানিয়ে বড় মেয়ে ও সংগীতশিল্পী সামিরা আব্বাসী ফেসবুকে বাবার সঙ্গে একটি ছবি শেয়ার করে আবেগঘনভাবে লেখেন, “আমার সোনার চান পাখী… আর দেখা হবে না?”
মুস্তাফা জামান আব্বাসী ছিলেন ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিন আহমদের তৃতীয় পুত্র। সংগীত ছিল তার রক্তে। তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে কলকাতায়। সংগীতে প্রথাগত শিক্ষা নিয়েছেন ওস্তাদ মুহম্মদ হোসেন খসরু এবং ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খাঁর কাছে। তার চাচা আব্দুল করিম এবং বোন ফেরদৌসী রহমানও ছিলেন সংগীতাঙ্গনের পরিচিত মুখ। এমন একটি সংগীত পরিবারে বেড়ে ওঠা আব্বাসীর জীবন ছিল সংগীত আর সাধনায় পূর্ণ।
তিনি ছিলেন সংগীতের গবেষক ও ইতিহাসবিদ। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ‘কাজী নজরুল ইসলাম এবং আব্বাসউদ্দীন আহমদ গবেষণা ও শিক্ষা কেন্দ্র’-এ তিনি গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, নজরুলসংগীতসহ বাংলা লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারায় তার গবেষণা আজ ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ৫০-এর বেশি। ‘ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি’ এবং ‘ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি-২’ নামের গ্রন্থে প্রায় ১২০০ গানের তথ্য সংকলিত রয়েছে। এছাড়া ‘আব্বাসউদ্দিন: মানুষ ও শিল্পী’, ‘ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি’, ‘জীবন নদীর উজানে’, ‘জলসা থেকে জলসায়’, ‘লালন যাত্রীর পশরা’, ‘মুহাম্মদের নাম’, ‘সুফি কবিতা’, ‘গালিবের হৃদয় ছুঁয়ে’সহ বহু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ তার প্রকাশিত কাজের মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভিতে ‘আমার ঠিকান’ এবং ‘ভরা নদীর বাঁকে’ নামের সংগীতভিত্তিক অনুষ্ঠান দুটি উপস্থাপনার জন্য তিনি আজও স্মরণীয়। পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেও তিনি পাঠকমনে জায়গা করে নিয়েছেন।
সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন ১৯৯৫ সালের একুশে পদক। এছাড়া নজরুল মেলায় আজীবন সম্মাননা, শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, আব্বাসউদ্দিন গোল্ড মেডেল, লালন পুরস্কার, মানিক মিয়া পুরস্কারসহ বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
তার স্ত্রী আসমা আব্বাসী ছিলেন শিক্ষিকা ও লেখক। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে তার মৃত্যু হয়। মুস্তাফা জামান আব্বাসী রেখে গেছেন দুই মেয়ে—সামিরা ও শারমিনী। আজ শনিবার জোহরের নামাজের পর গুলশানের আজাদ মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলা সংগীত ও সংস্কৃতির ইতিহাসে মুস্তাফা জামান আব্বাসী এক অনন্য নাম হয়ে থাকবেন। তার মৃত্যুতে জাতি হারাল এক শিল্পমনস্ক, জ্ঞানী ও নিরলস সাধককে, যার কর্ম ও কণ্ঠ যুগ যুগ ধরে বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।