কবিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবারও করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। চিহ্নিত হচ্ছে ভাইরাসটির নতুন নতুন সাব ভ্যারিয়েন্ট। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সংক্রমণ ঠেকাতে বন্দরে নজরদারি জোরদার করার পাশাপাশি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে সাতটি পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
আজ বুধবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব সতর্কতার কথা জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর।
তিনি বলেন, 'পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনা ভাইরাসজনিত সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা ভাইরাসের কয়েকটি নতুন সাবভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।'
'আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের বিস্তার প্রতিরোধে দেশের সব স্থল-নৌ-বিমান বন্দরের আইএইচআর ডেস্কে নজরদারি এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো জোরদার করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে করোনা শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রস্তুতির বিষয়েও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, করোনা শনাক্তে আবারও আরটি-পিসিআর ও র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি করোনার টিকা, প্রয়োজনীয় ওষুধ, অক্সিজেন, হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ ও এইচডিইউ সুবিধাসহ কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও সেবা প্রদানকারী স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম যেমন—কেএন-৯৫ মাস্ক, পিপিই ও ফেস শিল্ড নিশ্চিত করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে এসব প্রস্তুতি চলছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে দেশের বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও নৌবন্দরে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধিমালার (আইএইচআর) আওতায় পরিচালিত ডেস্কগুলোকে আরও সক্রিয় করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারতে তৈরি কোভিড-১৯ এর টিকা কোভ্যাক্সিন গ্রহণকারীদের একটি অংশের মধ্যে বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাওয়ার তথ্য দিয়েছে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক।
উত্তরপ্রদেশের বেনারসে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষকরা কোভ্যাক্সিন টিকা গ্রহণকারী ৯২৬ জনের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে তাদের এক তৃতীয়াংশের মধ্যে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দেখা পেয়েছেন। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে পরের বছর আগস্ট পর্যন্ত এই গবেষণা চলে।
তবে এই টিকার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক এই গবেষণাকে ত্রুটিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা অস্বীকার করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে ভ্যাকসিনটি নিরাপদ।
প্রতিষ্ঠানটি আরও বলেছে, কোভ্যাক্সিনের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা চালানো হয়েছে। এসব গবেষণা প্রতিবেদন পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় টিকাটিকে নিরাপদ হিসেবে পাওয়া গেছে।
বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বলেছেন, কোভ্যাক্সিন টিকাগ্রহণকারীদের মধ্যে শ্বাসনালীতে সংক্রমণ, চর্মরোগ, স্নায়ুরোগ, স্ট্রোক, হাইপোথাইরয়েডিজমের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। টিকাগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে ঋতুস্রাবে জটিলতাও দেখা গেছে।
এর আগে যুক্ররাজ্যের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা আদালতে দেওয়া বক্তব্যে তাদের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকার কথা স্বীকার করেছিল। ভারত ও বাংলাদেশে এই টিকা কোভিশিল্ড নামে পাওয়া যায়। যুক্তরাজ্যের আদালতে অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানায়, তাদের টিকাগ্রহণকারীদের অল্প একটি অংশের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধা ও রক্তে অণুচক্রিকা কমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
টিকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতটা উদ্বেগের
কোভিশিল্ডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা সামনে আসার পর কোভ্যাক্সিন নিয়ে এই গবেষণা অনেক মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে। তবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
ভারতের গঙ্গা রাম হাসপাতালের কার্ডিওলোজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ডা. অশ্বিনী মেহতা বলেন, গবেষণাটি খুব অল্প মানুষের মধ্যে পরিচালিত হয়েছে। এতে উদ্বেগের কিছু নেই। তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার হার খুবই কম। টিকার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য আরও অনেক মানুষের মধ্যে এই গবেষণা চালানো প্রয়োজন।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা ভ্যাকসিনের ভারতীয় সংস্করণ কোভিশিল্ডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় টিটিএস (থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোম) হতে পারে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা।
টিটিএসের ফলে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে যেতে পারে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে।
তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই দাবি করছেন, সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি কোভিশিল্ড টিকা নেওয়া অধিকাংশ ভারতীয় টিটিএসের ঝুঁকিতে আছেন।
এ নিয়ে দ্য হেলদি ইন্ডিয়ান প্রজেক্টের ফ্যাক্টচেক তথ্যে এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দাবি অর্ধসত্য। টিটিএস হতে পারে সত্যি, তবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
টিটিএসের উপসর্গের মধ্যে রয়েছে—শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, পা ফুলে যাওয়া, টানা মাথা ধরে থাকা ও পেট ব্যথা ইত্যাদি। একটু আঘাত পেলেই দাগ পড়ে যেতে পারে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানিয়েছে, যারাই কোভিশিল্ড টিকা নিয়েছেন, সবাই যে আক্রান্ত হবেন এমন নয়। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) তাদের ওয়েবসাইটে বলছে, 'এই টিকা নিরাপদ'।
কেরালায় ন্যাশনাল ইন্ডিয়া মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএমএ) কোভিড টাস্কফোর্সের কো-চেয়ারম্যান ড. জয়দেবন বলেন, 'কিছু বিশেষ ধরনের টিকা এবং আরও কিছু কারণের জন্য এই ধরনের ঘটনা কদাচিৎ ঘটতে পারে।'
'আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। যে অভিযোগগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো টিকা নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। তবে সাবধানে থাকা এবং কারও কোনো সমস্যা হলে চিকিৎসককে জানানো উচিত', বলেন তিনি।