বিশ্ববাণিজ্যের গতি-প্রকৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর বাজারে বাংলাদেশের প্রচলিত রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমছে। এই বাস্তবতায় রপ্তানি বাজারকে বহুমুখীকরণ এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মোকাবিলায় কৌশলগতভাবে এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। সরকার এখন এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) মাধ্যমে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে চীন, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়াসহ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ধাপে ধাপে জেইসি সভা আয়োজন করা হবে। ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে আগামী ১ জুন সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বেইজিং এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে এবং চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ও ১০০-১৫০ জন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি এতে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সভায় নেতৃত্ব দেবেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা।
চীনের সঙ্গে সভার এজেন্ডা চূড়ান্তে ইআরডি একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করেছে। এতে আম ও কাঁঠাল রপ্তানি, সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া, ই-কমার্সে সহযোগিতা এবং চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন শুল্কনীতি এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী শর্তাবলী বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই সরকার এখন বিকল্প বাজার খুঁজছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বলছে, এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিগুলো— বিশেষ করে আসিয়ান, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাও এই কৌশলের অন্যতম লক্ষ্য।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এটা সময়োচিত উদ্যোগ। এখনো আমরা রপ্তানিতে উত্তর আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। অথচ আমদানির বড় অংশ আসে চীন ও ইস্ট এশিয়া থেকে। এসব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো সময়ের দাবি।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “যতটা ভালো পরিকল্পনা, ততটাই জরুরি এর বাস্তবায়ন। এসব উদ্যোগ যেন ফলপ্রসূ হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কেবল রপ্তানি নয়, আমদানির বিকল্প উৎস, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও সহনশীল শর্তে ঋণ পাওয়ার বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দিতে হবে।”
জুলাই মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে জেইসি সভা আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে, যা ২০০৪ সালের পর প্রথম এমন উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়াকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনকেও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের সঙ্গে ডিজিটাল পেমেন্ট, ব্যাংক খাত সংস্কার, বন্ড ও পুঁজিবাজার উন্নয়ন, লজিস্টিকস ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশও সিঙ্গাপুরে স্বাস্থ্যসেবা সহজীকরণের বিষয়টি আলোচনায় এনেছে।
ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আগ্রহ মূলত হালাল পণ্যের রপ্তানি ও গ্রিন ফাইন্যান্সিং। ইআরডির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা আসিয়ানভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে ইন্দোনেশিয়ার সমর্থনও চেয়েছেন।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০২৮ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেয়েছে। র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক মনে করেন, “চীনে শুল্কমুক্ত সুবিধা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও রপ্তানি সক্ষমতা না বাড়ালে এ সুযোগ কাজে লাগানো যাবে না। চীনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করার দিকেও বাংলাদেশকে এগোতে হবে।”
সিপিডি চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি আমাদের জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। তাই বিকল্প বাজার খোঁজার এখনই সময়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানও হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য।”
তিনি আরও বলেন, “আগামী ২৫ বছরে এশিয়া হবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কেন্দ্র। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত কৌশলগতভাবে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করা।”
সংগৃহিত প্রতিবেদন