তাজ ইসলাম
কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লেখা বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী সরকারের নাম 'মুজিবনগর সরকার'। মুজিবনগরের পূর্ব নাম বৈদ্যোনাথতলা। ভবরপাড়া নামেও পরিচিত ছিল। তৎকালীন খুলনা জেলার বর্তমানে মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার বৈদ্যোনাথ ও ভবরপাড়ার আমবাগানে গঠিত হয় অস্থায়ী সরকার। যা প্রবাসী সরকার নামেও পরিচিত। পরবর্তীতে বৈদ্যোনাথতলা হয়ে যায় মুজিবনগর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানের বিদ্রোহের মাধ্যমে। প্রবাসী বা অস্থায়ী সরকার গঠন হয় ১৭ এপ্রিল। এই সরকারের যাত্রা ১০ এপ্রিল থেকে। ১৭ এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকতা বা পূর্ণতা পায়। অস্থায়ী সরকারের যাত্রাই ১০ এপ্রিল থেকে, গঠন হয় ১৭ এপ্রিল।
তাহলে ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিচয় কি ছিল? সরকার কে ছিল? এটি তো ঐতিহাসিক জিঙ্গাসা। এর উত্তর কি? কোন না কোন উত্তর তো আছেই। না থাকলেও জানতে হবে। পৃথিবীতে শূন্যস্থান বলতে কিছুই নাই। যা শূন্য দৃশ্যমান সেখানেও আছে অদৃশ্য হাওয়া। রাষ্ট্রে বা রাষ্ট্রের আইনে অদৃশ্য কিছু নাই, বায়বীয় কিছু আইন গ্রহণ করে না। ১০ এপ্রিল সরকারের যাত্রা। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত এদেশের পরিচয় কি তাহলে পূর্বপাকিস্থান? না ২৬ মার্চ একজন সেনা অফিসার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। প্রথম ঘোষণা মেজর জিয়া নিজের নামে দিয়েছিলেন। তা বলবৎ থাকলে এর নাম হত গৃহযুদ্ধ। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আত্মসমর্পিত নেতা শেখ মুজিবের নামে প্রদান করেন। শেখ মুজিব ছিলেন আওয়ামীলীগের নেতা। পূর্বপাকিস্তানের নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী নেতা। তার নামে পরবর্তী ঘোষণা হওয়ায় তা আর গৃহযুদ্ধ থাকেনি। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ এসব নামও ঠিকঠাক হয় জয়পরাজয়ের মাধ্যমে। নয় মাস যুদ্ধের পর বিজয় অর্জন করায় আজ যা স্বাধীনতা যুদ্ধ, পরাজিত হলে তাই হতো গৃহযুদ্ধ বা দেশ ভাগের ষড়যন্ত্র। তখন আইন ও বিচার মতে যা হতো তা আপন কল্পনায় বিশ্লেষণ করুন। আপন চিন্তা ও কল্পনাতেই নির্ণয় করুন শূন্যস্থানের চিত্র। চিত্র নির্মাণের আগে ১০ এপ্রিলের কথা বলি।
১০ এপ্রিল সরকার গঠনের প্রস্ততি নিলেন আওয়ামীলীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। এখানে একটা প্রশ্ন তুলুন নির্বাচন যে হয়েছিল তা জনগণ তাদের ভোটাধিকার কোন প্রশ্নে বা প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করেছিল? জনগণের প্রদত্ত ভোট কি গৃহযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ, পৃথক দেশ গঠনের অধিকারে দিয়েছিল? তারা ভোট প্রদান করেছিল নিজেদের পার্লামেন্টারিয়ান নির্বাচিত করতে। ৭০ এর নির্বাচন ছিল পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের সংসদে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার ভোট প্রদান। তারা আওয়ামীলীগকে ভোট দিয়েছিল। পরবর্তীতে পরিস্থিতির প্রয়োজন তারা মিটিয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ঘটনা এমনই হয়। আইনত এইসব প্রতিনিধিকে তার জনগণ পৃথক সংসদের জন্য ভোট দেননি। ভোট দিয়েছেন অখণ্ড পাকিস্তানের সদস্য নির্বাচিত করতে। পরিস্থিতি প্রেক্ষাপট পাল্টিয়ে দিয়েছে। এখানে অনেক প্রশ্ন তুলতে পারবেন। পরাজিত হলে তা উত্থাপিত হতো। জয়ী হওয়ায় চ্যাপ্টার এখানেই ক্লোজ। পরাজিত হলে অনেককিছুর ঝুঁকি নিয়ে ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত যারা ছিলেন তাদের পরিচয় কি? ইতিহাস তাদের পরিচয় উল্লেখ করেনি? নাকি ইতিহাস লেখা হয়েছে ভিন্নভাবে! ২৬ মার্চ বা তার আগে আওয়ামীলীগ কি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল? শেখ মুজিব কি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন? শেখ মুজিবকে আপনার অদূরদর্শী মনে হয়? শেখ মুজিব কি নির্বাচন করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে? ৭ মার্চ কি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র? আপনি এটিকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মানতে পারেন, মূলত তা স্বাধীনতার ঘোষণা না। ওটা আবেগ, স্বাধীনতার পরম্পরা। ৭ মার্চের ভাষণকে কিছুতেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নাই। তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এই দিন যদি শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন তাহলে আন্তর্জাতিকভাবেই শেখ মুজিব ফেঁসে যেতেন। পাকিস্তান কেন পৃথিবীর কোন দুর্বল রাষ্ট্রও প্রকাশ্য জনসমাবেশে দেশ ভাঙার ডাক দেওয়া নেতাকে ঘরে ফুল বিছানায় ঘুমানোর আয়োজন করে রাখে না। ৭ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, যুদ্ধের ডাক দিলেন আর পাকিস্তান করে গেলেন নিয়মতান্ত্রিক আলোচনা! তা অবিশ্বাস্য ঠেকে না? ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের ঐতিহাসিক দিনলিপি কি? তাতো ইতিহাসের পাতাতেই আছে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিব বা আওয়ামীলীগের শেষ বিবৃতি ছিল 'আলোচনা ফলপ্রসূ'। পরদিন আওয়ামীলীগের কর্মসূচি তো তৎকালীন জাতীয় পত্রিকা সমুহেই প্রিন্টেড। দেশব্যাপী ছিল ২৬ মার্চে আওয়ামীলীগের নিয়মতান্ত্রিক হরতাল বা ধর্মঘট।
২৫ মার্চে শেখ মুজিবের সবিস্তার তৎপরতার কথা জানা যায় তাজউদ্দীন আহমদের হতাশা থেকে। তার মেয়ের পিতাজীবনী ও আত্মজীবনী থেকে। শেখ মুজিবের আত্মসমর্পণও গবেষণার বিষয়। ২৬ মার্চ আওয়ামীলীগ চলে গিয়েছিল ব্যাকফুটে। একজন মেজর দাঁড়িয়ে গেলেন জাতির পাশে। নিজের জীবন বাজি রাখলেন বুলেটের কাছে। পাকিস্তানের চৌকশ সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আশংকা ছিল। সামরিক আইনে তার মৃত্যু ছিল সময়ের ব্যাপার। এমনকি তার অনুগত একজন সৈনিকের হাতেও মারা যেতে পারতেন। নিজের নামেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই ঘোষণা ছিল বীরত্বপূর্ণ। এই ঘোষণা ছিল ঐতিহাসিক দাবী পূরণের মূহুর্ত। পরবর্তীতে আত্মসমর্পণ করা শেখ মুজিবের নামে দেওয়া ছিল রাজনৈতিক ও বাস্তবতার সমন্বয়। আওয়ামীলীগের মতো সুগঠিত দলও ১০ তারিখ পর্যন্ত ছিল বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত। স্বাধীনতা বা সংগ্রাম তাদের সাংগঠনিক সীদ্ধান্ত হলে সব শেষ শেখ মুজিবের আত্মসমর্পণের পরপরই। ২৫ মার্চের পাকিস্তানিদের আক্রমণের পরপরই আসতে পারত ঘোষণা। ২৫ মার্চের পরই ঘোষণা ছিল আবশ্যিক। তা আসেনি। বস্তুতই ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় লেগেছে তাদের পূনঃঐক্যবদ্ধ হতে, একত্র হয়ে সীদ্ধান্ত নিতেই সময় লেগেছে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত। তার আগেই শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধ। যুদ্ধ মূলত বাঁধিয়েছে পাকিস্তানের ভুল পদক্ষেপ। গণহত্যার মতো ভুল পদক্ষেপ ও বাঙালী জাতীর প্রতি তাদের নির্মমতা, দমননীতিই যুদ্ধ বাঁধার মূল কারণ।শক্তি জুগিয়েছে মেজর জিয়া। এবং পাশে দাঁড়িয়েছে জনগণ। বিদ্রোহী সেনা শক্তি ও জনতার পাশে আওয়ামীলীগ দাঁড়িয়েছে একান্ত বাধ্য হয়ে। ১০ এপ্রিলে আওয়ামীলীগ যদি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের আওয়াজ তুলতো তাহলে ফলাফল হত বিরূপ। কাজেই জনস্রোতে তারা মিশে যায় ১০ এপ্রিলে এসে। তার আগে ক্ষমতা কার হাতে ছিল? পাকিস্তানের? না পাকিস্তান তখন ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত। স্বভাবতই বলা যায় ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের পূর্ণ ক্ষমতা ছিল বিদ্রোহ করা মেজরের নিয়ন্ত্রণে। প্রবাসী বা অস্থায়ী সরকার গঠনের আগের সময়টা তারই শাসনের, তারই নিয়ন্ত্রণের। ২৬ মার্চের আগে এই দেশ ছিল পূর্বপাকিস্তান। ২৬ মার্চ কালুরঘাট ঘোষণার পরপরই তার নাম হয় 'বাংলাদেশ'। ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের সরকার মেজর জিয়ার সরকার। অস্থায়ী সরকার হল স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্টেপের সরকার।
১০ এপ্রিলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যে অধিকার বলে একত্রিত হয়েছিল মেহেরপুরে, ৫ আগস্টের পর একই অধিকারে একত্রিত হতে পারত ছাত্রজনতা। জুলাইয়ে জনতা নেমে এসেছিল রাজপথে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা জনতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে পালিয়েছে। তখনকার নেতৃত্বের সামনে অগাধ সুযোগ ছিল নতুনভাবে যাত্রা শুরুর। তাহলে আজকের বাংলাদেশ আরও ভিন্নমাত্রায় হাঁটতে পারত। জনতার সংগ্রাম শুধু হাসিনা হটাওয়ে ছিল না। জনতার সংগ্রাম ছিল নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্নে। জমতার পূর্ণ সমর্থন ছিল সংগ্রামী নেতৃত্বের প্রতি। ৭০ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছিল কেবল একজন সংসদ সদস্য হিসেবে। তারা শেষ পর্যন্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতির চাহিদায় গঠন করলেন স্বাধীন দেশের পৃথক সংসদ। ২০২৪ এর বিজয়ীরাও একই সূত্র মেনে গঠন করতে পারতো নতুন ধারা। তাহলে গণহত্যাকারী আওয়ামীলীগ ও তার দোসরদের বিচার প্রক্রিয়া সহজ থেকে সহজতর হতো। ৫ আগস্টের বিজয়ীপক্ষ হাঁটছে গতানুগতিক পথে। এজন্যই বের হতে সাহস পায় আওয়ামীলগ। আওয়ামীলীগ আইনত নিষিদ্ধ না। কিন্ত প্রেক্ষাপট ও কার্যত আওয়ামীলীগ অপরাধী সংগঠন। এটা ঠিক সেই ব্যক্তির মতো আইনত সে এখনও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত না কিন্ত সে খুনি ও বিচারাধীন। সভ্য মানুষ ও তার সমাজ তাকে চিহ্নিত করে রেখেছে খুনি হিসেবে। জুলাইয়ের বিজয়ী শক্তির সামনে এখন একটাই মন্ত্র ঐক্যবদ্ধ থাকা। বাংলাদেশের যত দল আছে সবার পরিচয় একপক্ষে তারা মানে বাংলাদেশ। অপরপক্ষে আওয়ামীলীগ। জুলাইয়ে অবস্থান তাই ছিল একপক্ষে আওয়ামীলীগ অপরপক্ষে বাংলাদেশ।এন্টি আওয়ামীলীগই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার জয় ধরে রাখতে পারলে রাজনীতি করা যাবে। আওয়ামীলীগ ফিরে আসলে একা আসবে না। সাথে ফিরে আসবে ইফতারে নজরদারী, ঈদজামাতে ফিরবে আক্রমন। ফিরে আসবে আয়নাঘর, খুন, গুম, নয়পল্টনে বিএনপি অফিসে তালা, সারাদেশের জামায়াতের অফিসে তালা, জঙ্গি নাটক, জামায়াত শিবির ট্যাগ দিয়ে গ্রেফতার-নির্যাতন, অর্থনীতি ধ্বংস, লুটপাট, পরিকল্পিত ফাঁসি, ফিরে আসবে বায়তুল মোকাররমের পালিয়ে যাওয়া খতিব, রাজপথে দাঁড়ি ধরে বেতমিজ যুবকের দৃশ্য, লগী-বৈঠার তাণ্ডব, আলেমদের নামে কুৎসিত কথা, ফিরে আসবে মক্তবের কায়দা জঙ্গি বই হয়ে। ফিরবে ডিবি হারুনের ভাতের হোটেল, কবি নামে খবিসদের অহরহ হুমকি। কাজেই মনে রাখতে হবে আওয়ামীলীগ ও বাংলাদেশ পরস্পর বিরোধী। আওয়ামীলীগ থাকলে ১৬ ডিসেম্বর হয়ে যায় অন্যদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিজয়। অথচ ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। রাজনীতি করতে হলে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখতে হবে। ২০২৪ জুলাই ইতিহাসকে সামনে রাখার বিজয় সংগ্রাম। ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, থাকা আবশ্যক।
মন্তব্য করুন
আপনার ইমেল প্রকাশ করা হবে না