লেখক: সামিরা হুসাইন
বিবিসি নিউজ
যখন তদন্তকারীরা তাড়াহুড়ো করে তৈরি করা একটি দেয়াল ভেঙে ফেললেন, তখন তারা একাধিক গোপন কারাকক্ষ আবিষ্কার করলেন।
সেটি ছিল একেবারে নতুন করে ইট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া একটি দরজা—যার উদ্দেশ্য ছিল ভিতরে লুকিয়ে থাকা সত্যকে আড়াল করা।
ভিতরে, একটি সরু করিডোরের দু’পাশে ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘর। চারদিক অন্ধকারে ঢাকা ছিল।
তদন্তকারী দল হয়তো এই গোপন জেলখানার হদিস কখনোই পেত না—যেটি ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একদম কাছেই অবস্থিত—যদি না মীর আহমদ বিন কাসেম ও অন্যদের স্মৃতিচারণা থাকত।
বাংলাদেশের অপসারিত এক নেতার সমালোচক এই ব্যক্তি সেখানে আট বছর বন্দি ছিলেন।
কারাগারে থাকাকালীন অধিকাংশ সময় তিনি চোখ বেঁধে ছিলেন, তাই তিনি আশপাশের শব্দ থেকেই দিকনির্দেশনা নেওয়ার চেষ্টা করতেন—আর তিনি স্পষ্টভাবে মনে রাখতে পেরেছিলেন উড়োজাহাজ অবতরণের শব্দ।
গত আগস্টে গণবিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে তদন্তকারীরা আহমদ বিন কাসেমের মতো শত শত ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন, এবং তখন গোপন কারাগারের বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। অনেকেরই বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তাদের বেআইনিভাবে হত্যা করা হয়েছে।
তদন্তকারীরা বলছেন, ঢাকার বিমানবন্দরের পাশের সেই গোপন জেলখানাসহ অন্যান্যগুলো পরিচালনা করতেন মূলত একটি অভিজাত counter-terrorism ইউনিট—র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা—যারা সরাসরি শেখ হাসিনার আদেশে কাজ করতেন।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, “সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, জোরপূর্বক গুমের প্রতিটি ঘটনাই প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি, নির্দেশ বা আদেশে হয়েছে।”
হাসিনার দল বলছে, এসব অভিযোগ সম্পর্কে তারা কিছুই জানত না, তাদের কোনো দায় নেই, এবং এসব অভিযান সামরিক বাহিনী একাই চালিয়েছে—যদিও সেনাবাহিনী এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সাত মাস কেটে গেলেও আহমদ বিন কাসেম ও অন্যদের মনে এখনও তীব্র ভয় রয়ে গেছে, কারণ যারা তাদের বন্দি রেখেছিল, সেই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা এখনও মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আহমদ বিন কাসেম বলেন, তিনি কখনোই টুপি ও মাস্ক ছাড়া বাইরে বের হন না।
“আমি যখনই কোথাও যাই, সবসময় পেছনে নজর রাখি।”
তিনি ধীরে ধীরে কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠেন, বিবিসিকে দেখাতে চান কোথায় তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। একটি ভারী লোহার দরজা ঠেলে তিনি মাথা নিচু করে ঢোকেন আরেকটি সরু দরজা দিয়ে, তার "নিজের" ঘরে—যে সেলে তিনি আট বছর বন্দি ছিলেন।
“এটা যেন জীবন্ত কবরের মতো—বাইরের পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন,” তিনি বিবিসিকে বলেন। সেখানে কোনো জানালা ছিল না, প্রাকৃতিক আলো প্রবেশের কোনো দরজাও ছিল না। ভিতরে থাকাকালীন তিনি দিনের আলো ও রাতের অন্ধকারের পার্থক্য বুঝতেই পারতেন না।
আহমদ বিন কাসেম, চল্লিশের কোঠায় একজন আইনজীবী, আগেও কিছু সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, কিন্তু এই প্রথম তিনি কোনো গণমাধ্যমকে সরাসরি সেই ছোট্ট সেলের ভিতরে নিয়ে গেলেন, যেখানে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল।
টর্চের আলোয় দেখা যায়, ঘরটি এতটাই ছোট যে একজন গড়পড়তা মানুষের সোজা হয়ে দাঁড়ানোও কষ্টকর। বাতাসে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। কিছু দেয়াল ভাঙা, মেঝেতে পড়ে আছে ইট আর কংক্রিটের টুকরো—যেন শেষ মুহূর্তে অপরাধীরা প্রমাণ ধ্বংস করতে চেয়েছিল।
“[এটি] একটি বন্দিশিবির মাত্র। আমরা দেখেছি, দেশে ৫০০, ৬০০, এমনকি ৭০০টিরও বেশি সেল রয়েছে,” বলেন প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, যিনি বিবিসির সঙ্গে জেলটি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। “এটি প্রমাণ করে যে ঘটনাগুলো ব্যাপক এবং সংগঠিতভাবে ঘটানো হয়েছে।”
আহমদ বিন কাসেম স্পষ্টভাবে মনে রেখেছেন তার সেলের হালকা নীল টাইলসগুলো, যেগুলোর কিছু এখন মেঝেতে পড়ে আছে ভাঙা অবস্থায়। এসবই তদন্তকারীদের এই নির্দিষ্ট ঘরটিতে নিয়ে এসেছিল। নিচতলার সেলগুলোর তুলনায় এটি বেশ বড়—১০ ফুট বাই ১৪ ফুট (৩ মিটার বাই ৪.৩ মিটার)। এক পাশে একটি স্কোয়াটিং টয়লেটও রয়েছে।
এই শব্দই তদন্তকারীদের বিমানবন্দরের কাছাকাছি এক সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। সেই ঘাঁটির মূল ভবনের পেছনে তারা খুঁজে পান একটি ছোট, জানালাবিহীন, সুরক্ষিত ভবন—ইট ও কংক্রিট দিয়ে তৈরি—যেখানে বন্দিদের রাখা হতো।
এটি ছিল সবার চোখের সামনেই, কিন্তু গোপনে লুকানো।
কষ্টদায়ক বিশদ বিবরণে আহমদ বিন কাসেম ঘরজুড়ে হাঁটেন, বর্ণনা করেন কীভাবে তিনি বন্দি জীবনের বছরগুলো পার করেছেন। গ্রীষ্মকালে ভীষণ গরম থাকত—সহ্য করার মতো নয়। তিনি মেঝেতে কুঁকড়ে বসে দরজার নিচের ফাঁকের কাছে মুখ রাখতেন, একটু বাতাস পাওয়ার আশায়।
“মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ মনে হতো,” তিনি বলেন।
আবার ফিরে এসে সেই শাস্তির জায়গা ঘুরে দেখা যেন নিষ্ঠুরতা। কিন্তু আহমদ বিন কাসেম মনে করেন, বিশ্বকে এসব দেখতে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
“যারা এই ফ্যাসিস্ট শাসনকে সহায়তা করেছে—উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, সামরিক শীর্ষ নেতৃত্ব—তারা এখনও তাদের পদে বহাল আছেন,” তিনি বলেন।
“আমাদের ঘটনাগুলো সামনে আনতে হবে, এবং যারা ফিরতে পারেননি তাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ও যারা বেঁচে গেছেন, তাদের জীবনে পুনর্বাসনের জন্য যা কিছু করা দরকার, তা করতে হবে।”
পূর্ববর্তী কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আহমদ বিন কাসেমকে ঢাকার প্রধান গোয়েন্দা দপ্তরের berai Aynaghor বা “আয়নার ঘর” নামে পরিচিত একটি কুখ্যাত বন্দিশালায় রাখা হয়েছিল। তবে এখন তদন্তকারীদের ধারণা, এমন আরও অনেক বন্দিশালা ছিল।
আহমদ বিন কাসেম বিবিসিকে জানিয়েছেন, প্রথম ১৬ দিন বাদে তিনি পুরো সময়ই র্যাবের ঘাঁটিতে বন্দি ছিলেন। তদন্তকারীদের এখন সন্দেহ, প্রথম অবস্থানটি ছিল ঢাকার পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অধীনে।
তিনি বিশ্বাস করেন, তার "গুম" হওয়ার পেছনে ছিল তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয়। ২০১৬ সালে তিনি তার পিতার পক্ষে আইনি সহায়তা দিচ্ছিলেন—যিনি দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’র একজন জ্যেষ্ঠ নেতা ছিলেন। সেই সময় তিনি বিচারের মুখোমুখি ছিলেন এবং পরে তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়।
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা'র প্রকাশিত প্রতিবেদন।
অসমাপ্ত জুলাই বিপ্লব পূর্ণ করুন : মাহমুদুর রহমান
বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা নয় সম্পদ
কথা বললে গ্রেপ্তার, প্রতিবাদ করলে গুম আর রাজপথে নামলে গুলি - এই নিয়মে মিশরে ৩০ বছর স্বৈরশাসন চালান হোসনি মোবারক।
গণঅভ্যুত্থানোত্তর সময়েও জাতীয় কবির জন্মজয়ন্তী উদযাপনের দায়সারা প্রস্তুতি!