পহেলা অগ্রহায়ণে ফিরে আসুক বাংলা নববর্ষ
সরদার আব্বাস উদ্দিন
অগ্রান মাস তো আইসে পড়তিছে। ওশ পড়া শুরু অইছে। ল্যাপ তোশক রোদ্দুরি দিতি অবে। ধান পাইকে গেইছে। পরবাসী আইসে যদি দ্যাহে ল্যাপ তোষক দিয়ে বুটকা গোন্দ কচ্ছে, মোন্দ কতা। ধান পান উইঠে গেলিই নতুন চালির পিঠে খাতি অবেনে। জামাই মাইয়ের জন্নি ডিহিতি চাইল কুটে রাখতি অবেনে।
গ্রামের সাধারণ মানুষের আঞ্চলিক ভাষায় বলা এই কথার অর্থ হলো- "অগ্রহায়ণ মাস তো এসে পড়েছে। কুয়াশা পড়া শুরু হলো। লেপতোশক রোদ্রে দিতে হবে। ধান পেকেছে। ধান কাটার শ্রমিকেরা এসে যদি দেখে লেপতোশকে বাজে গন্ধ, খারাপ বিষয় হবে। ধান উঠলেই নতুন চালের পিঠা খেতে হবে। জামাই ও মেয়ের জন্য ঢেঁকিতে চাল গুড়ি করে রাখতে হবে।"
নববর্ষের শুরুতে এবং নবান্নে গ্রামীন জীবনের এমন সংলাপ সেদিনও ছিল, আজও আছে, আগামীতে চিরন্তন হয়ে থাকবে।
এক সময় অগ্রহায়ণ ছিল বছরের প্রথম মাস। 'অগ্র' শব্দের অর্থ 'আগে' আর 'হায়ণ' শব্দের অর্থ 'বছর'। বছরের আগে বা শুরুতে ছিল বলেই এই মাসের নাম 'অগ্রহায়ণ'। এটি হেমন্ত ঋতুর দ্বিতীয় মাস। "অগ্রহায়ণ" শব্দের অভিধানিক অর্থ বছরের যে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রীহি (ধান) উৎপন্ন হয়। অতীতে এই সময় প্রচুর ধান উৎপাদিত হতো বলে এই মাসটিকেই বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। বাঙালি হিন্দু সমাজের বিশ্বাস অনুযায়ী, অগ্রহায়ণ মাস বিবাহের পক্ষে বিশেষ শুভ মাস। পশ্চিমবঙ্গে এই মাসেই নবান্ন উৎসব ও পূজার বিশেষ আয়োজন করা হয়। বাঙালীর জীবনে নববর্ষ ও নবান্নের আবেদন সামাজিক থেকে সংস্কৃতির রন্ধ্রে পৌঁছে গেছে। অগ্রহায়ণে নববর্ষের উৎসবে জড়িয়ে আছে প্রাচীন ইতিহাস। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়ে সেই ইতিহাস হৃদয় থেকে হৃদয়ের পাতায় অদৃশ্যে লেখা হয়ে আছে। একটা সময় কার্তিক মাস এলেই গ্রামের সাধারণের মধ্যে উৎকণ্ঠা জাগত। কী করে পার করা যাবে কার্তিক! যার নামই ছিল ‘মরা কার্তিক’। দেশের উত্তরাঞ্চলে আশ্বিন-কার্তিক মাসের পরিচিতি ছিল তীব্র অভাবের মাস। ‘মঙ্গা’ নামে বেশি পরিচিত। মঙ্গার শেষে নতুনের বার্তা নিয়ে পহেলা অগ্রহায়ণে নতুন বছরের আগমন ঘটতো আনন্দের নবান্ন নিয়ে। অগ্রহায়ণ প্রতিটি ঘরেই বয়ে আনতো উৎসবের বন্যা।
বৈশাখ আগে বছরের প্রথম মাস ছিল না। অতীতে এই মাস একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। কখনও প্রথমে কখনও মাঝামাঝিতে এসেছে। একাদশ শতকে গুজরাতি হেমচন্দ্রসুরী তাঁর ‘অভিধান চিন্তামণি’ গ্রন্থে অব্দ বা বছরের বিভিন্ন মাসের তালিকা শুরু করেন অগ্রহায়ণ মাস দিয়ে।
ড. নীহার রঞ্জন রায় বলেছেন "এক সময় অগ্রহায়ণ মাসে বাংলা নববর্ষের সূত্রপাত হতো। তখন নবান্ন ছিল বর্ষ শুরুর দিন। অগ্রহায়ণ নামই তার প্রমাণ।"
ফসলের ও চাষের সঙ্গে রয়েছে বাংলা মাসের গভীর সম্পর্ক। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে প্রকৃতির রং রূপের পরিবর্তন ঘটে। সেই পালায় বৈশাখ মাস ঝড়-তুফান আকস্মিক বিপর্যয় নিয়ে এলেও প্রকৃতি অগ্রহায়ণের নবান্নকে মানুষের জীবনে বর্ণিল করে আনে। অগ্রহায়ণ মাস এলেই ভরা ক্ষেতে সোনালি ধানের গুচ্ছে মধুর হাসি নিয়ে আসে নবান্ন।
বাংলা সনের শুরু কোথা থেকে অথবা কেনো বাংলা সন প্রবর্তন করা হলো এইসবের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে কিছু করুণ বাস্তবতা। সেখানে দেখা যাবে বাংলা সাল গণনাও এক, দুই থেকে শুরু হয়নি। ইতিহাস অনুসারে বাংলা সনের প্রবর্তনের সময় ধরা হয় ইংরেজী ১৫৫৬ সাল থেকে। প্রবক্তা ছিলেন মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। ওই সালেই তিনি দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে আদিল শাহ শূরের সেনাপতি হিমুকে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসনে বসেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে বাদশাহ আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তাঁর সভাসদ জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীর সহযোগিতায় ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে ‘তারিখ-এ- এলাহি’ নামে নতুন এক বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন। সে সময়ের কৃষকদের কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়, যা পরে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সময়ে প্রচলিত রাজকীয় সন ছিল ‘হিজরি সন’, যা চন্দ্রসন হওয়ার প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতো না। এ কারণে সম্রাট আকবর একটি সৌরভিত্তিক সন প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, যা কৃষকদের ফসল উৎপাদনের সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালে তার রাজত্বকালের ২৯তম বর্ষের ১০ কিংবা ১১ মার্চ তারিখে এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে তারিখ-এ-এলাহী প্রবর্তন করেন। সিংহাসনে আরোহণের পরপরই তিনি একটি বৈজ্ঞানিক, কর্মপোযোগী ও গ্রহণযোগ্য বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, যেখানে দিন ও মাসের হিসাবটা যথাযথ থাকবে। বিখ্যাত পণ্ডিত ও সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে, হিজরি বর্ষপঞ্জি কৃষিকাজের জন্য মোটেই উপযোগী ছিল না কারণ চন্দ্র বছরের ৩১ বছর হয় সৌর বছরের ৩০ বছরের সমান। চন্দ্র বছরের হিসাবেই তখন কৃষকশ্রেণির কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হতো অথচ চাষবাস নির্ভর করতো সৌর বছরের হিসাবের ওপর। চন্দ্র বছর হয় ৩৫৪ দিনে আর সেখানে সৌর বছর হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। ফলে দুটি বর্ষপঞ্জির মধ্যে ব্যবধান থেকে যায় বছরে ১১ বা ১২ দিন। ফলে বাংলা সনের জন্ম ঘটে সম্রাট আকবরের এই রাজস্ব আদায়ের আধুনিকীকরণের প্রেক্ষাপটে।
প্রথমদিকে মাসের নাম ছিল ফারওয়ারদিন, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহরিয়ার, আবান, আযার, দে, বাহমান ইত্যাদি। পরে নাক্ষত্রিক নিয়মে বাংলা সনের মাসগুলোর নামকরণ করা হয়। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন এই নামগুলো নেওয়া হয়েছে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাকা জাতির রাজত্বের সময় প্রচলিত শাকাব্দ থেকে:
১. বিশাখা থেকে বৈশাখ। ২. জাইষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য। ৩. আষাঢ়া থেকে আষাঢ়। ৪. শ্রাবনা থেকে শ্রাবন। ৫. ভাদ্রপাদা থেকে ভাদ্র। ৬. আশ্বিনী থেকে আশ্বিন। ৭. কৃতিকা থেকে কার্তিক। ৮. পুস্যা থেকে পৌষ। ৯. আগ্রৈহনী থেকে আগ্রহায়ণ। ১০. মাঘা থেকে মাঘ। ১১. ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন। ১২. চিত্রা থেকে চৈত্র
৯৬৩ হিজরির প্রথম মাস মহররমকে ‘তারিখ- এ- এলাহি’র প্রথম মাস ধরে গণনা করা শুরু হয় তখন তা বৈশাখ মাসের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় বৈশাখকেই ধরা হয় “তারিখ-এ-এলাহি”র প্রথম মাস। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। যারা নির্ধারিত খাজনা মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে পারতেন না, বিশেষকরে ভূমির মালিকদের নিকট থেকে বর্গাচাষি হিসেবে যেসব কৃষকেরা চাষাবাদ করতেন তাদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো। ফলে এই উৎসবটি একটি অংশের জন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হলেও কৃষকদের জন্য হয়ে ওঠে বিভীষিকাময় উৎসব। যার রূপ পরিবর্তন হয়ে হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। শামসুজ্জামান খানের মতে, বাংলার মুঘল সুবাদার মুর্শিদ কুলি খান প্রথম পুন্যাহ এর রীতি শুরু করেন, যার অর্থ হচ্ছে "ভূমি রাজস্ব আদায়ের উৎসবের দিন", এবং তিনি বাংলা দিনপঞ্জির সূচনা করার জন্য আকবরের রাজস্বের নীতি ব্যবহার করেন।
পরিশেষে বলতে চাই, যদিও যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ খুব একটা শোনা যায় না। ঢেঁকি ছাঁটা চাল দিয়ে ভাত খাওয়া হয় না। তারপরও নতুন ধানের আগমনের অগ্রহায়ণ বাংলাদেশীদের মনে বয়ে আনে আনন্দঘন পরিবেশ। এখনো অগ্রহায়ণে তৈরি হয় নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর- পায়েসসহ নানা উপাদান। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে পহেলা অগ্রহায়ণ নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া দাওয়ার ধুম। নবান্ন আর পিঠেপুলির উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। তাই কাল বৈশাখী খ্যাত বৈশাখেকে বছরের প্রথম মাস না ধরে বরং হাজার বছরের ঐতিহ্য অগ্রহায়ণকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ব্যবহার করা এখন সময়ের অন্যতম দাবী। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বাঙালি বৈশাখকে নববর্ষ পালনে নিশ্চয়ই সাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। যেহেতু নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক একটি আনন্দ উৎসব তাই প্রতি বছর নবান্ন উৎসবের সাথে বাংলা নববর্ষের উৎসব পহেলা অগ্রহায়ণে পালন বাঙালী জাতিকে ভিন্নমাত্রা দেবে বলে আমার বিশ্বাস। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় নবান্ন উৎসবে গ্রামগঞ্জে আয়োজন করা হবে গ্রামীণ মেলার। এসব মেলায় শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নামবে।
তথ্যসূত্রঃ পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত কলাম ও গুগল উইকিপিডিয়া।
ইসলামী ব্যাংকের নতুন এমডি মুহাম্মদ ওমর খানকে যাকাত ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সংবর্ধনা
মন্তব্য করুন
আপনার ইমেল প্রকাশ করা হবে না