বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ৯ম শাহাদাতবার্ষিকী আজ রোববার। ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে মিথ্যা অভিযোগ ও সাজানো সাক্ষীর ভিত্তিতে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে এ দিন তাকে হত্যা করে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংগঠন, শীর্ষ ইসলামী ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন দেশের সমালোচনা ও ফাঁসি কার্যকর না করার অনুরোধ উপেক্ষা করে নির্মমভাবে ২০১৬ সালের এই দিনে তাঁকে হত্যা করে জুলুমবাজ সরকার। ফরমায়েশী তদন্ত, অসংলগ্নতা তথ্য উপাত্ত প্রদানও বেআইনীভাবে হত্যার আয়োজন চূড়ান্ত করা হয়।
শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী একটি জীবন, একটি ইতিহাস। আল্লাহ প্রদত্ত এক বিস্ময়কর প্রতিভা। ব্যক্তিগত জীবনে স্বচ্ছ চিন্তা, সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত, নরমদিল ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী, অত্যন্ত ভদ্র-নম্র, মার্জিত, পরিশীলিত, মৃদুভাষী এক অসাধারণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শান্তি ও স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের প্রিয় দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর এবং বাংলাদেশের প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ, সুলেখক, ইসলামপ্রিয় জনগণের রুহানি উস্তাদ ও বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ। ২০১৫ সালে আমেরিকার বিখ্যাত সংস্থা “দ্য রয়েল ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার” প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের ৫০০ প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন একজন মেধাসম্পন্ন লেখক। ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য গ্রন্থ। তার লেখা বইয়ের মধ্যে কুরআনের আলোকে মু'মিনের জীবন, মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব ও কর্তব্য, এক পরাশক্তির অন্যায় যুদ্ধ আতঙ্কিত করেছে বিশ্বের মানুষকে, গণতন্ত্র গণবিপ্লব ও ইসলামী আন্দোলন, ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ, স্মৃতির পাতা থেকে, নারী সমাজে দাওয়াত ও সংগঠন সম্প্রসারণের উপায়, কারাগারের স্মৃতি, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) মক্কার জীবন, ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদ, ৮ম জাতীয় সংসদের ৪টি ভাষণ, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের সংস্কার, রাজনীতির স্বার্থে ধর্ম বনাম ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি, ইসলামী আন্দোলন : সমস্যা ও সম্ভাবনা, কুরআনের আলোকে মু'মিনের জীবন, ইসলাম ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব, কুরআন রমযান তাকওয়া, কুরআন ও হাদীসের আলোকে রাসূল মুহাম্মদ স., ইসলামী আদাবে জিন্দেগী, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়, আল-কোরআনের পরিচয় এবং ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন অন্যতম।
নিজামী ১৯৪৩ সালের ৩১শে মার্চ পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে কামিল এবং ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তার পিতার নাম লুৎফর রহমান খান। ব্যক্তিগত জীবনে নিজামী সামসুন্নাহারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সামসুন্নাহার ঢাকার মানারাত ইন্টারন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগের সাবেক সেক্রেটারি। এই দম্পত্তির চার পুত্র ও দুই কন্যা রয়েছে। মাওলানা নিজামী ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে তার ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। পরপর তিন বছর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রআন্দোলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দুইবার তিনি গোটা পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মওলানা নিজামী ছাত্রজীবন শেষ করে বৃহৎ ইসলামী আন্দোলন জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন। ১৯৭৮-১৯৮২ পর্যন্ত তিনি ঢাকা মহানগরীর আমীর ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩-১৯৮৮ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি । ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং আমীর নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত (২০০০সাল) দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকে আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী ৯০ এর আন্দোলন, ৯৬ তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রর্বতনের আন্দোলন সহ তিনি অন্যান্য সকল রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপামর জনতার সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর তিনি। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন ২০০১-২০০৩ এবং ২০০৪-২০০৬ সেশনে। তিনি ২০০৭-২০০৯ এবং ২০১০-২০১২ সেশনে পুনরায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বচিত হন।
১৯৯১ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে তার দেয়া বক্তব্য তিনি রাজনীতিতে সরকারি দল ও বিরোধী দলের কেমন আচরণ কেমন হওয়া উচিত এই বিষয়ে এই বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রথমে সরকারি দলকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন শিক্ষণীয় ভূমিকা নিতে হবে তাদেরকেই। জাতি এটাই কামনা করে। পরমত সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। বিরোধী দলের সমালোচনা সহ্য করার অনুরোধ করেন। সেই সাথে তিনি বিরোধী দলের ব্যাপারে বলেন, “জাতি বিরোধীদলের ভূমিকাকেও গঠনমূলক দেখতে চায়। আবেগ নির্ভর হয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে গিয়ে যাতে পরিবেশ ক্ষুন্ন না হয় সে দিকে খেয়াল রাখা দরকার। অপজিশনের খাতিরে অপজিশন, বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা যাতে না করে”। তিনি আরো বলেন, “অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। যে জাতি অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না সত্যিকার অর্থে সে জাতি তার ভবিষ্যতকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে পারেনা। কিন্তু ইতিহাসের আলোচনা শিক্ষাগ্রহনের উদ্দেশ্যেই হওয়া উচিত। কোন তিক্ততা সৃষ্টির জন্য অতীতের ইতিহাসের আলোচনা হলে যদি পরিবেশ বিঘ্নিত হয় সে ধরণের আলোচনা যেন আমরা সকলেই পরিহার করি”।
মাওলানা নিজামী সবসময় ইসলামপ্রিয় দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছেন। তিনি তার বিভিন্ন বক্তব্যে বলেন, “জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এদেশের সকল ইসলামী দলকে আপন মনে করে, অন্তর থেকে তাদেরকে শ্রদ্ধা করে। আমি এতটুকু বলতে চাই, ভুল বুঝাবুঝির কারণে হোক বা যে কারণেই হোক জামায়াত ইসলামীর বিরুদ্ধে যারা সমালোচনা করেন তাদের বিরুদ্ধেও আমরা কোন কথা বলি না বলবো না। সমালোচনায় জড়িয়ে পড়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির মত পরিস্থিতিতে জামায়াত ইসলামী আজ পর্যন্ত শরিক হয়নি। ভবিষ্যতেও হবেনা“।
মাওলানা নিজামীর একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কখনোই কাউকে ধমক দেয়া, বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি অসম্মান কিংবা কোন প্রকার কটুক্তি করেননি। অথচ বিরোধী দলের প্রতি কটুক্তি করা বাংলাদেশের খুবই প্রচলিত আচরণ। স্বভাবসুলভ শান্ত ভঙ্গিতে তিনি সমালোচনার জবাব দিতেন। সংসদে কারো বক্তব্যের বিরোধীতা করার প্রয়োজন হলে অথবা প্রতিবাদ জানানোর দরকার হলে তিনি তা করতেন অত্যন্ত সম্মানের সাথে। ওলামা মাশায়েখদের এক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেয়ার সময় তার বিনয় আমাদের কাছে আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি ইসলামিক দলের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও বলেন “এখানে যারা আসছেন তারা সবাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অথবা মসজিদের ইমাম এবং খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন। আমি নিজে শিক্ষক নই, কোন মসজিদের ইমাম নই খতীব নই। আমি ছাত্র এবং মুক্তাদী। সুতরাং সমস্ত ওলামায়ে কেরামকে আমি আমার ওস্তাদতুল্য মনে করি সম্মান করি। আমি আপনাদের ইমাম ও খতীব হিসেবে শ্রদ্ধা করি”। এভাবে সব দল মত পেশার মানুষকে তিনি সম্মান করতেন। কথা বলতেন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের শতকরা পচাশি জন লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই মাওলানা নিজামী কৃষি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব নিয়েই কৃষকদের জন্য কাজ করার ব্যাপারে মনযোগী হন। ফসলের ন্যায্য পাওনা, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশকসহ যাবতীয় কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাদের যাবতীয় সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং এর সুষ্ঠু সমাধানকল্পে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এলক্ষ্যে তিনি মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক সফরের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, বিজ্ঞানী ও কৃষকদের মাঝে প্রানচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনেন। মাওলানা নিজামী কৃষি মন্ত্রনালয় দায়িত্ব পালনকালে “চাষীর বাড়ী, বাগান বাড়ী” শ্লোগানকে দেশব্যাপী জনপ্রিয় শ্লোগানে পরিনত করেন। তার একান্ত প্রচেষ্টায় দেশের প্রতিটি চাষীর বাড়িকে এক একটি বাগান বাড়ি হিসাবে গড়ে তুলে নিজেদের পুষ্টি চাহিদা পূরন বাড়তি উপার্জন এবং স্বাবলম্বিতা অর্জন সহজ হয়েছে। মাওলানা নিজামীর ব্যক্তিগত অভিপ্রায়ে দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় বৃক্ষ রোপন অভিযানে পৃথকভাবে ফলজ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এরপর থেকে আলাদাভাবে ফলজ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি উদযাপন করা হয়। শুধু তাই নয়, নিজে উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন ফল চাষ প্রকল্প ঘুরে ঘুরে দেখেছেন, জনগণকে উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। তাই ধানের ফলন বৃদ্ধি এবং সঠিক সংরক্ষনের দিকে ছিল তার সতর্ক দৃষ্টি। ধানের প্রধান দুই শক্র ইদুর এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রনে তার মন্ত্রনালয়ের পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসা করার মত। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা সম্মেলনে তার ছিল সরব ভূমিকা। বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে মাওলানা নিজামীর সুপরিকল্পিত নির্দেশনার ছাপ। আখ, পাট, তুলা, ভূট্টা, মধু এমনকি শীতকালীন শাকসবজি পর্যন্ত তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তার দিক নির্দেশনায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম রাজশাহী, নওগা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাড়িয়ে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলায়ও সম্প্রসারিত হয়েছে। দেশের কৃষি উন্নয়নে মাওলানা নিজামীর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো বি এ ডি সি বীজ উইং শক্তিশালী করণ, মাটিরগুনগত মান পরীক্ষাকরণ, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম পর্যালোচনা, কৃষিবিদ কৃষিবিজ্ঞানীদের যথাযথ পদোন্নতি এবং ব্লক সুপারভাইজার পদবী পরিবর্তন করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পদ চালু।
বিগত ২০০৩ সালে ২৫শে মে কৃষি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব থেকে মাওলানা নিজামীকে শিল্প মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। উদ্দেশ্য ভেঙে পড়া বিপর্যস্ত রাষ্ট্রীয় শিল্পখাতকে পুনরুজ্জীবিত গতিশীল ও শৃংখলা ফিরিয়ে আনা। দায়িত্ব নিয়েই মাওলানা নিজামী দেশের শিল্পক্ষেত্রে নতুন গতিসঞ্চারের প্রয়াস পান। বাংলাদেশের শিল্পখাতের সমস্যাগুলো তিনি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ সমস্যা দূরীকরণকল্পে তিনি দেশব্যাপী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দ্রুত বিকাশের লক্ষে পৃথক শিল্পনীতি প্রনয়ন করেন । এ নীতি প্রনয়নকালে বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তা ও সংগঠন, উন্নয়ন সহযোগী, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে মত বিনিময় করা হয়। নতুন শিল্পনীতি ২০০৫ সালে ৩২টি শিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর হিসাবে চিহ্নিত করে সেগুলোর মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। দেশের সামগ্রিক শিল্পখাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে সার্বিক দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য মাননীয় শিল্পমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি দিকনির্দেশনা কমিটিও গঠন করা হয়। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর এ কমিটি বৈঠকে মিলিত হয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিরাজমান সমস্যা সমাধানকল্পে বাস্তবসম্মত কর্মপন্থা ও সুপারিশমালা প্রনয়নের কাজ করে চলেছে। ২০০১-০২ অর্থ বছরে যেখানে জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান ছিল ১৫.৭৬% ভাগ, সেখানে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাড়িয়েছিল ১৬.৫৮% ভগে। একই বছরে শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৪৪% ভাগ যা ২০০৫ সালে এসে দাড়িয়েছিল ৭.৪৮% ভাগে। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার যোগ্য নেতৃত্বে দেশের শিল্পভিত্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে । তারই ঐকান্তিক ইচ্ছা ও প্রানান্তকর প্রয়াসে কর্ণফুলী পেপার মিলের বন্ধকৃত কস্টিক ক্লোরিন প্লান্ট, খুলনা হার্ডবোর্ড মিল এবং রংপুর সুগার মিল পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়েছে। ফলে তখন এ ২টি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানই লাভজনক অবস্থায় পরিচালিত হয়। এই লাভ ধরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন দীর্ঘ ১০ বছরের মধ্যে ২০০৫-০৬ আখ মাড়াই মৌসুমে মাওলানা নিজামী মন্ত্রী থাকাকালে প্রথম বারের মতো ৭০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ উন্নয়নের জন্য হাজারীবাগে অবস্থিত ট্যানারি শিল্পকে সাভারে নতুন স্থাপিত চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন চলছে। এছাড়া ফার্মাসিউটিকেল ইন্ডাস্ট্রি, প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি ও অটোমোবাইল ওয়ার্কশপের জন্য পৃথক শিল্পনগরী গড়ে তোলার কার্যক্রম হাতে হয়েছে। লবন আমাদের দৈনন্দিন ভোগ্যপন্যের একটি অপরিহার্য উপদান। দেশে মোট সাড়ে ১১ লাখ মে. টন লবনের চাহিদা থাকলেও বিগত ২০০৫-০৬ উৎপাদন মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ১৫ লাখ ৭৫ হাজার মে. টন লবন উৎপাদিত হয়েছে যা এ যাবত কালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। নি:সন্দেহে এ অর্জন মাওলানা নিজামীর সঠিক দিক নির্দেশনার ফসল। মাওলানা নিজামীর দায়িত্বাধীন শিল্পনালয়ের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো বিসিকের মাধ্যমে ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৩৭৫ জন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, বি এস টি আই এর আধুনিকায়ন, ফুড ফর্টিফিকেশন এলায়েন্স গঠন, ন্যাশনাল এক্রিডিটেশন এবো গঠন ইত্যাদি।
২০১০ সালের ১৭ই মার্চ একটি জনসভায় ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমির রফিকুল ইসলাম খান নিপীড়নের কথা উল্লেখ করে নিজামীর জীবনকে নবী মুহাম্মদ-এর সাথে তুলনা করেন। ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত করেছে, এমন অভিযোগে ২১শে মার্চ বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমির মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম খাঁন ও ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ছাত্রশিবিরের সভাপতি আ স ম ইয়াহিয়ার নামে মামলা করেন। ২৯ জুন, ২০১০ তারিখে রমনা থানা পুলিশ প্রেসক্লাবের সামনে থেকে মতিউর রহমান নিজামীসহ আরো তিনজন সিনিয়র জামায়াত নেতাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ২০১০ সালের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর জামায়াতের আমিরের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষ। ২৮ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগ আমলে নেয়। ২০১২ সালের ২৮ মে থেকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো ১৬টি অভিযোগে নিজামীর মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এ বিচার করা হয়। ট্রাইব্যুনালের সাজানো রায়ে নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি প্রমাণিত হয়েছে জানিয়ে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ৪টিতে ফাঁসির আদেশ প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ঐ রায়ের বিরুদ্ধে ৬ই জানুয়ারি তিনি আপিল করলে ট্রাইব্যুনালের দেয়া দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ। এরপর তিনি ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। যা ৫ মে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ আবেদনটি খারিজ করে দেয়। ২০১১ সালের ৪ই মে নিজামীকে চট্টগ্রামে আটক ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় গ্রেফতার করা হয়। ৭ই সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে তার জামিন আবেদন আদালত নাকচ করে দেন। ৩০শে জানুয়ারি ২০১৪ সালে নিজামীসহ আরো ১৩ জন আসামীকে অস্ত্র চোরাচালান মামলায় অভিযুক্ত প্রমাণিত হওয়ার পর আদালত ফাঁসির দন্ডাদেশ দেন। যদিও ২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর এই মামলায় তিনিসহ সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও কয়েক জনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রায় কার্যকরের নির্বাহী আদেশ ১০ মে সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে পাঠানো হয়। রাত ১২টা ১০ মিনিটে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মহান রবের পানে চলে যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রাত ১টা ৩০ মিনিটে কারা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে শহীদ নিজামীর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রওনা করে তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে। সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে লাশবাহী বহর পৌঁছে সাঁথিয়ার মনমথপুরে জন্মভূমিতে। সেখানে পূর্ব থেকেই উপস্থিত ছিলেন তার পরিবারের সদস্যগণ ও হাজারো শোকাহত জনতা। শহীদ নিজামীর কফিনবাহী গাড়ির বহর বাড়িতে পৌঁছলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সাধারণ মানুষ তাদের নেতাকে এক নজর দেখার জন্য আকুতি করতে থাকে এবং ঢুকরে কেঁদে ওঠে। কিন্তু মানুষের এই কান্না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হৃদয় গলাতে পারেনি, ফলে শেষবারের মত তাদের প্রিয় নেতার মুখ দেখতে পারেনি সাধারণ জনতা। তাদের সমস্বরের কান্নায় মনমথপুরের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। উপস্থিত জনস্রোত সামলাতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হয়। তারপর কফিনবাহী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িসংলগ্ন মনমথপুর কবরস্থানে। সেখানে পূর্ব থেকেই অপেক্ষমাণ হাজার হাজার মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে জানাযায় দাঁড়িয়ে যায়। সকাল ৭টায় অনুষ্ঠিত জানাযায় হাজার হাজার মানুষ শরিক হন। জানাযা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আইনশৃংখলা বাহিনীর লোকেরা লাশ নিয়ে যায় কবরস্থানে। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো সাধারণ মানুষ কবরস্থানে ঢুকে পড়তে চাইলে আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের বাধা দেয়। তাদের বাধা উপেক্ষা করে হাজার-হাজার মানুষ কবরস্থানে প্রবেশ করে। শতবাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে দাফনের পর একই স্থানে ২৬ বার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়, যা ইতিহাসে বিরল।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর গায়েবানা জানাযা দেশে বিদেশে বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। এসব জানাযায় লাখ লাখ জনতা অংশগ্রহণ করে। কেন্দ্রীয়ভাবে ১১ মে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে একাধিক গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত তৌহিদী জনতা মাওলানা নিজামীর জন্য চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে তাঁর শাহাদাতের মর্যাদা কামনা করেন। গায়েবানা জানাযা শেষ হওয়ার পর মুসল্লিরা শ্লোগান দিতে দিতে ও ভি চিহ্ন দেখিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে যান। চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দান ও তার সংলগ্ন সড়ক, সিলেটের সরকারি আলিয়া মাদরাসা ময়দান, রাজশাহীর হেতেম খা গোরস্থানসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও বিভিন্ন উপজেলা, জনপদে গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের বাইরে মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, জেদ্দা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক, মিশিগান, ব্রুকলেন, লন্ডনের আলতাব আলী পার্ক, তুরস্কের আঙ্কারা, ইস্তাম্বুল, ওমান, বাহরাইন, কাতার, মালয়েশিয়া, কুয়েত, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, কানাডার মন্টিয়াল, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, কাশ্মিরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মাগফেরাত কামনায় অসংখ্য গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। আল্লাহ এই গুণী মানুষকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা ও জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।
অসমাপ্ত জুলাই বিপ্লব পূর্ণ করুন : মাহমুদুর রহমান
বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা নয় সম্পদ
কথা বললে গ্রেপ্তার, প্রতিবাদ করলে গুম আর রাজপথে নামলে গুলি - এই নিয়মে মিশরে ৩০ বছর স্বৈরশাসন চালান হোসনি মোবারক।
গণঅভ্যুত্থানোত্তর সময়েও জাতীয় কবির জন্মজয়ন্তী উদযাপনের দায়সারা প্রস্তুতি!