রাবি ছাত্র ফারুক হত্যাকান্ড
-আবু সালেহ মো. ইয়াহইয়া
কি ঘটেছিল সেদিন:
২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক ন্যাক্কারজনক ঘটনার সুত্রপাত হয়। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা ৭ টার দিকে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের বলপূর্বক হল থেকে বের করে দিতে চাইলে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে হালকা সংঘর্ষ বেঁধে যায়।
সংঘর্ষে উভয় পক্ষের কয়েকজন আহত হয়। এ ঘটনার জের ধরে বিভিন্ন হলে অবস্থানরত শিবিরের শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেতার করে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও বাসাবাড়ী থেকেও ছাত্রশিবিরের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
মধ্যরাতে রাবি প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে শিবির নিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলোতে ভাংচুর শুরু করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। অবস্থানরত ছাত্রদের লোহার রড, হকিষ্টিক ও চাপাতি দিয়ে গণহারে কুপিয়ে গুরুতর আহত করতে থাকে। পরে শিবির কর্মীরা রাত সাড়ে ১২টার দিকে হলগুলো থেকে আহত শিবির কর্মীদের উদ্ধার করে। এ সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা শিবির কর্মীদের বাধা দিলে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
শিবির কর্মীদের উপর পুলিশ ৫ শতাধিক রাউন্ড টিয়ারসেল,রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। একই সাথে ছাত্রলীগ প্রায় ৫০ রাউন্ড গুলী বর্ষণ করে। পরদিন সকালে আমীর আলী হলের দক্ষিণ দিকের একটি ম্যানহোলে ফারুক হোসেন নামে এক ছাত্রের লাশ পাওয়া যায়।
ফারুক গণিত বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। তার বাড়ী জয়পুরহাট জেলায়। ঘটনার পূর্বে তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা না গেলেও ঘটনার দায়ভার শিবিরের ঘাড়ে চাপাতে ছাত্রলীগ ফারুককে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করে। এ ঘটনায় পুলিশসহ উভয় সংগঠনের ৫০ জনের মত আহত হয়।
এ ঘটনায় প্রথমে ছাত্রলীগ ও পুলিশ বাদী হয়ে শিবিরের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে একই ঘটনায় শিবির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পনেরটিরও বেশী মামলা করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে শিবিরের বিরুদ্ধে চিরুনী অভিযান চালানো হয়। শিবিরের রাবি শাখার তৎকালীন সভাপতি শামসুল আলম গোলাপসহ কয়েক হাজার শিবির নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। শামসুল আলম গোলাপ এ মামলায় দীর্ঘ সাড়ে তিনবছর কারাভোগ করেন।
মিডিয়ার বিকৃত উপস্থাপন:
যেহেতু ঘটনাটি পুলিশ ও ছাত্রলীগের যৌথ প্রযোজনায় সংঘটিত হয়েছে সেহেতু ঘটনার পরপরই তারা একই সূরে ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে বক্তব্য দিতে থাকেন। আর তাদের বক্তব্যকে পূজি করে জাতীয় দৈনিক ও টিভি চ্যানেল গুলোতে শিবির বিরোধীতায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার হতে থাকে। বিভিন্ন মিডিয়া এ ঘটনায় শিবিরকে জড়িয়ে সংবাদ পরিবেশন করলেও কেউই প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি।
পরবর্তিতে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দলের জেরে এ ঘটনা সংগঠিত হয়েছে বলে সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করে শিবির বিবৃতি দিলেও বেশীরভাগ মিডিয়াই তা প্রচার করেনি। উল্টো শিবিরকে জড়িয়ে বিভিন্ন কাল্পনিক তথ্য পরিবেশন করে।
ছাত্রলীগের বক্তব্য এবং প্রশাসনের দলীয় ক্যাডারদের কর্তৃক দায়েরকৃত মামলার এজহারগুলোকে সংবাদের অন্যতম সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে মিডিয়া। বেশীরভাগ মিডিয়াই ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনার মূলে যাবার কোন চেষ্টাই করেনি।
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দল, হল দখলের খায়েশ এবং শিবিরের উপর হামলার বিষয়টি বেমালুম চেপে যাওয়া হয়।
দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাবিতে ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক হল এবং সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন মেসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় শিবির। ওই রাতে শিবির ক্যাডাররা ছাত্রলীগ কর্মী ও গণিত বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী ফারুক হোসেনকে নির্মমভাবে খুন করার পর লাশ সৈয়দ আমীর আলি হল সংলগ্ন মানহোলে ফেলে রাখে (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৩)।
অনলাইন পত্রিকা বাংলানিউজে ৪ নভেম্বর ২০১১ তারিখে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শিবির ক্যাডারদের আঘাতে ছাত্রলীগকর্মী ফারুক নিহত হয়। দৈনিক কালের কণ্ঠের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবিরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে ছাত্রলীগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। সমাবেশ থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়। (সূত্র: কালের কণ্ঠ ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৩)
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দলের বলি ফারুক?
হত্যাকান্ডের ঘটনায় রাবি'র নবগঠিত ছাত্রলীগ কমিটির শীর্ষ নেতাদের কোন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়নি। অনেকের ধারনা পদবঞ্চিত ও পদপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের নীরব শিকার ফারুক হোসেন কী না ? নিহত ফারুক হোসেন পদবঞ্চিত নেতা তৌহিদুর রহমান ডালিম গ্রুপের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের কাউন্সিলে ডালিম সেক্রেটারি প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু নবগঠিত কমিটিতে ডালিম গ্রুপের কোন নেতাকেই মূল্যায়ন করা হয়নি। এমনকি সংঘর্ষে ছাত্রলীগের আহতদের অধিকাংশই পদবঞ্চিত গ্রুপের সমর্থক।
বর্তমান কমিটির নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ আহত হয়নি। তাই সঙ্গত কারণেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রশিবির যদি ছাত্রলীগের ওপর হামলা করেই থাকে তাহলে বর্তমান কমিটির নেতারাই তাদের টার্গেট হবার কথা। কিন্তু তা না হয়ে শুধুমাত্র পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরাই আহত হলেন কেন? দৃশ্যত শিবিরের সাথে সংঘর্ষ বাধলেও ছাত্রলীগের নতুন কমিটির নেতারা এখানে বড় ধরনের একটি গেম খেলেছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
হল দখলের উদ্দেশ্যে শিবিরের সাথে সংঘর্ষ বাধিয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটির নেতারা পদবঞ্চিত বিদ্রোহী গ্রুপটিকে পুলিশের সহযোগিতায় নি:শেষ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আর এ ক্ষেত্রে বিদ্রোহী গ্রুপের সমর্থক ফারুক হোসেনকে বানানো হয় বলিরপাঁঠা । (দৈনিক সংগ্রাম, নয়া দিগন্ত, আমার দেশ১১ ফেব্রয়ারী ২০১০)
শিবির উৎখাতই ফারুক হত্যার উদ্দেশ্য !
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের শক্ত অবস্থান দেশী বিদেশী চক্রান্তকারীদের কোনভাবেই সহ্য হচ্ছিলনা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিবিরকে বিতাড়িত করতে নানা ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সে ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করা হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ১৩ মার্চ’০৯ নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শিবির সেক্রেটারী মেধাবী ছাত্রনেতা শরীফুজ্জামান নোমানীকে।
কিন্তু তারপরও ক্যাম্পাস থেকে শিবিরকে তাড়াতে না পেরে নতুন করে ঘৃন্য চক্রান্তে মেতে উঠে কুচক্রীমহল। ফারুক হত্যা সে চক্রান্তেরই ফসল। এ হত্যাকান্ডের মাধ্যমে এক ঢিলে দুই নয়, তিন পাখি মারার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক- রাবি থেকে শিবিরকে উৎখাত করা। দুই- শিবিরের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের ফাঁসানো। তিন- ছাত্রলীগের বিদ্রোহী গ্রুপকে শায়েস্তা করা। সরকারী সকল মেকানিজম ব্যবহার করে সফলভাবে তা বাস্তবায়নও করা হয়।
৮ ফেব্রুয়ারী রাত ২ টা থেকে ভোর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ টি হল দখল করতে একযোগে ছাত্রশিবিরের উপর হামলা করলে সংঘর্ষ বাধে । সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে শাহ মাখদুম হলের টিভি কক্ষে আশ্রয় নেন ফারুকসহ আরও অনেকেই। ঘটনা রাতে ঘটায় অনেক কিছুই থেকে যায় চোখের আড়ালে। পরদিন সকালে ম্যানহোল থেকে নিহত ফারুকের লাশ উদ্ধারের পরপরই অন্যসব ঘটনার মত ছাত্রলীগ ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে বক্তব্য দেয়। আর গণমাধ্যমগুলো ছাত্রলীগের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব নিয়ে শিবিরের বিরুদ্ধে ফলাওকরে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। ঘটনার আদ্যপান্থ বিশ্লেষণ করলে কতিপয় প্রশের উদ্রেক হয়, যার কোনটির উত্তর আজও জাতি জানতে পরেনি।
প্রশ্ন:১. প্রত্যক্ষদর্শী অনেক শিক্ষর্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ভোরের আগ পর্যন্ত সংঘর্ষের স্থল থেকে ম্যানহোল পর্যন্ত পুরো রাস্তা র্যাব-পুুলিশ ঘিরে রাখে। কাউকে যেতে দেয়া হয় নি সেখানে। এ থেকে বুঝা যায় ফারুকের লাশ পুলিশ ও র্যাবের সামনে দিয়েই ম্যানহোলের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়, পুলিশের সামনে দিয়ে লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় আসামীদের ধরা হয় নি কেন? তাহলে কি ছক আঁকা পথে পুলিশ কাউকে লাশ সরিয়ে ফেলতে সাহায্য করেছে?
প্রশ্ন:২. সংঘর্ষ চলে ভোর পর্যন্ত। অথচ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ম্যানহোলের মত সংকীর্ণ আবদ্ধ জায়গায় পুলিশ লাশ খুজে পেল কী করে? তাহলে কি পুলিশের আগেই জানা ছিল?
প্রশ্ন:৩. সংঘর্ষ শুরু বঙ্গবন্ধু হলে। চুড়ান্ত সংঘর্ষ বাধে শেরই বাংলা হলে আর শেষ হয় হবিবুর রহমান হলের সামনে। সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সংঘর্ষ চলে জিয়া হলের সামনে। তাহলে মুল টার্নিং পয়েন্টের এ তিন হলে তল্লাশী না চালিয়ে শুধুমাত্র আমির আলী হলের পেছনে তল্লাশী চালানোর কারণ কি?
প্রশ্ন:৪. প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী চলা সংঘর্ষে একটি লাশ পাওয়ার পর থেমে যায় তল্লাশী অভিযান। তাহলে কি মাত্র একজন খুন হওয়ার বিষয়টিও পুলিশের জানা ছিল?
প্রশ্ন:৫. এসএম হলের গেস্টরুমে আহত ১১ জনকেই তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নেয়া হলো। একই সাথে অবস্থানকারী ফারুক কিভাবে বাদ পড়লো?
জোরালো যুক্তিসম্পন্ন এসব প্রশ্ন রাবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে এবং সচেতন মহলের মনে জাগলেও আজ পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন জবাব পাওয়া যায়নি। এমনকি সরকার আজ পর্যন্ত মূল খুনিকে সনাক্তও করতে পারে নি। অথচ শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে সারা দেশে গ্রেফতারাভিযান চালানো হয়। এর আগে খবর নিয়ে জানা যায়, রাবি ছাত্রলীগের মধ্যে অনেক দিন ধরেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলে আসছিল। ঘটনার তিনদিন আগে দীর্ঘদিন পরে ক্ষমতাসীন হওয়া ছাত্রমত্রৈীর সাথে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ বাধে। ঘটনার রাতে বামপন্থী অনেক নেতাকে দলবদ্ধ হয়ে ঘুরতেও দেখা গেছে ক্যাম্পাসে। সংঘর্ষের সময় বামছাত্ররা ক্যাম্পাসে কি করছিল তা আজও অজানা রয়ে গেছে।
পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ দৈনিক প্রথম আলো ‘পুলিশের পায়ে পড়ে বলেছিলাম, ভাই বাঁচান' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে ঘটনার সময় পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তা ও অসহযোগিতার ব্যাপারে আহত ছাত্রলীগ কর্মী আসাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করে বলা হয়, পুলিশের রহস্যজনক নিস্ক্রিয়তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
আহত আসাদের দাবি, সে ঘটনার আহত হয়ে পুলিশ বক্স্রের কাছে গিয়ে বাঁচার জন্য আকুতি করে পুলিশের সহযোগিতা চায়। কিন্তু বিদ্রোহী গ্রুপের সমর্থক হওয়ায় পুলিশ তাকে আশ্রয় না দিয়ে লাথি মেরে প্রত্যাখ্যান করে।
ঘটনার সাথে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দল যদি জড়িত না থাকত তাহলে ছাত্রলীগ কর্র্মীকে পুলিশ সাহায্য করলো না কেন? এটা স্পষ্ট যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রশিবিরকে উৎখাত করার সুযোগে ছাত্রলীগের নতুন কমিটির নেতাকর্মীরা পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় বিদ্রোহী অংশের নেতাকর্মীদের উৎখাতের কাজও সেরে ফেলে নিপূন কৌশলে। প্রথম আলোর রিপোর্টে দেখা যায়, নিহত ফারুক হোসেনের রুমমেট শফিউল্ল¬াহও পুলিশের সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হন।
সঙ্গত কারণেই বলা যায়, সংঘর্ষে আহত ছাত্রলীগ কর্মী আসাদ ও শফিউল্লাহকে যে অজ্ঞাত কারণে পুলিশ সাহায্য করেনি, সেই একই কারণে শফিউল্ল¬াহর রুমমেট ফারুক হত্যাকারীরা অবাধে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে লাশ নিয়ে ম্যানহোলে ফেলে দিলেও পুলিশ কোন ভ’মিকা রাখেনি।? ছাত্রলীগের হামলা, পুলিশী তল্লাশী, গ্রেফতার ও নির্যাতন ফলে শিবির কর্মীরা যখন প্রাণ বচাতে হল থেকে পালাতে ব্যস্ত তখন কিভাবে তারা এমন একটি হত্যাকান্ড ঘটিয়ে লাশ ক্যাম্পাসের ম্যানহোলে ফেলে দিতে পারে? গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও হলসমূহ যখন পুলিশের নিশ্চিদ্র টহলদারীতে ছিল, তখন পুলিশী সহযোগিতা ছাড়া হত্যাকান্ডের পাশাপাশি লাশ স্থানান্তর করার ঘটনা বিশ্বাস করা কঠিন। (দৈনিক সংগ্রাম ১৩ ফেব্রুয়ারী)
জামায়াত-শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতাদের ফাসানোর চেষ্টা:
ফারুক হত্যাকান্ডের মুল লক্ষ্য ছিলদেশব্যাপী জামায়াত শিবিরের উপর একটা রাজনৈতিক ক্রাকডাউন চালানো। আর তাইতো ঘটনার পরপরই কোন তথ্য উপাত্ত ছাড়াই আগের দিনে অনুষ্ঠিত ‘রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতের মহাসমাবেশে’র বক্তাদের দায়ী করা হয়। ঘটনার পর রাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাবিবুর রহমান হল শাখার শিবির সভাপতি রাইজুল, আমির আলি হল সভাপতি ইকরাম, লতিফ হল সভাপতি হাসমত আলী লিটনসহ অসংখ্য নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা হয় পুলিশের ইচ্ছেমতো স্বীকারোক্তি।
রিমান্ডের পর শিবির নেতাকর্মীদের প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় স্ট্রেচারে করে আদালতে হাজির করা হলেও আবারো রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। তারপরও তাদের মুখ থেকে পছন্দমত কথা বের করতে না পেরে নিজেদের লেখা প্রতিবেদনে জোর করে স্বাক্ষর নেয়া হয়। এতে বলা হয় জামায়াত শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা এ হত্যাকােেন্ডর সাথে জড়িত। এরপর তা ছড়িয়ে দেয়া হয় গণমাধ্যমে। আর আমাদের গণমাধ্যমগুলো পুলিশের পক্ষ থেকে দেয়া তথ্যের কোন যাচাই বাছাই না করে দেদারসে প্রচার করতে থাকে।
তবে তৎকালিন শিবির সভাপতি শামসুল আলম গোলাপকে ২০১০ সালের ২৪ মার্চ আটকের পর ২৫ মার্চ সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হলে তিনি দৃঢ় অথচ স্পষ্ট ভাষায় বলেন, সেদিনের ঘটনায় জামায়াতের কোন পর্যায়ের কোন নেতার সাথে তার যোগাযোগ হয়নি। শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউল করিম ভাইর সাথে যোগাযোগ হলে তিনি পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করতে বলেন। তিনি আরো বলেন, এই হত্যার সাথেও শিবির জড়িত থাকার প্রশ্নই আসেনা। মিডিয়ার কল্যাণে গোটা বিশ্ববাসী তার এই বক্তব্য শোনা ও দেখার সুযোগ পায়।
চিরুনী অভিযান: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নিষ্ঠুর রূপ
ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাজশাহীর ঘটনার সমুচিত জবাব দেয়া হবে। একজন দায়িত্বশীল ব্যাক্তি হয়ে আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে এনে ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার বদলে প্রতিশোধ নেবার কথা বলে তিনি দেশবাসীকে অবাক করে দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আইজিপি স্বয়ং রাজশাহী অবস্থান করে শিবির উৎখাত অভিযানে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু শুধু রাজশাহীতে শিবির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার নির্যাতনে সরকারের মনের জ্বালা মিটেনি। তাই এবার পুরো দেশেই চিরুনী অভিযান শুরুর ঘোষনা দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। গ্রেফতার বানিজ্যে মেতে উঠে র্যাব-পুলিশের যৌথ বাহিনী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, কলেজের ছাত্রাবাস, মেস, বাসা-বাড়ী কোন কিছুই বাদ যায়নি তাদের অভিযান থেকে। শিবির কর্মী সন্দেহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাশরুম থেকে এমনকি পরীক্ষার হল থেকেও গ্রেফতার করতে এতটুকু কুণ্ঠা বোধ করেনি পুলিশ বাহিনী। গভীর রাতে চোর ডাকাতের মত বাসা-বাড়ীতে হানা দিয়ে বাপ ছেলেকে একত্রে আটক করা হয়। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি থাকলেই এমনকি মসজিদে নামাজরত অবস্থায়ও দেখলেই শিবির সন্দেহে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। মা বোনদেরকেও টেনে হিচড়ে অমানবিকভাবে গ্রেফতার করতে এতটুকু দমেনি শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী।
গ্রেফতারের পাশাপাশি সমানতালে মূল্যবান সামগ্রীর লুটপাট করা হয়। কম্পিউটার, লেপটপ, মোবাইলসহ একাডেমিক বই, সার্টিফিকেট কোন কিছুই বাদ পড়েনি লুটের তালিকা থেকে। সারা দেশে চলে হরিলুটের মহোৎসব। প্রায় দশ হাজার শিবির নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্রদের গ্রেফতারের পর ক্ষান্ত দেয় পেটুয়া বাহিনী। এভাবে দেশব্যাপী চালানো হয় এক রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্য। প্রতিটি হত্যাই নিন্দাজনক। কিন্তু এভাবে একটি হত্যাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির তৈরি করে সরকার তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
ভাবটা এমন, যেন দেশে এর আগে কোন হত্যাকান্ডই ঘটেনি। অথচ সরকারের এ আমলেই শুধু রাবিতেই সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের হাতে নৃশংস ভাবে খুন হয়েছেন ৫ জন মেধাবী ছাত্র। আর সারা দেশে ২৭ জন। কিন্তু কৈ, একটি হত্যার জন্যতো এমন কোন অভিযান পরিচালিত হয়নি। চিরুনী অভিযান দূরে থাক, সুষ্ঠু তদন্ত এমনকি কোথাও কোথাও মামলা পর্যন্ত গ্রহণ করেনি পুলিশ। একই দেশে দুই নীতি। এ যেন অদ্ভুত হীরক রাজার দেশ।
দেশের মেধাবী ছাত্রদের একমাত্র পছন্দের ঠিকানা ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এমন নিষ্ঠুর রুপ দেখে বিবেকমান সকল মানুষের কাছে এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয় যে, ফারুক হত্যাকান্ড ছিল সরকারের ঘৃন্য ষড়যন্ত্রের নীল নকশার বাস্তবায়ন মাত্র।
কয়েক দফায় তদন্তকারী কর্মকর্তার পরিবর্তন:
১২ মার্চ ২০১২ ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বদলি করে সরকার। নতুন করে মামলাটি তদন্তের ভার দেয়া হয় রাজপাড়া থানার ওসি জিল্লুর রহমানকে (সূত্র দৈনিক সমকাল, ১৩ মার্চ, ২০১৩)।
জামায়াত নেতাদের ফাসাতে ইচ্ছেমত তদন্ত প্রতিবেদন তৈরী করতে কয়েক দফায় পরিবর্তন করা তদন্ত কর্মকমর্তাদের। প্রথমে মতিহার থানায় মামলা করা হলেও পরে মামলাটি মহানগর গোয়েন্দা শাখায় স্থানান্তর করা হয়। গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অন্যত্র বদলী হওয়াসহ ৪ জন তদন্ত কর্মকর্তার হাত বদল হয়ে সর্বশেষ এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান রাজপাড়া থানার ওসি জিল্লুর রহমান।
সাজানো মামলায় রাজনৈতিক চার্জশীট:
ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর ৩০ জুলাই ২০১৩ ফারুক হত্যা মামলার অভিযোগ পত্র দাখিল করে পুলিশ। রাজশাহী মহানগর মূখ্য হাকিম আদালতে এই হত্যামামলার ১২৬৯ পৃষ্টার অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার ৫ম তদন্তকারী কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান। অভিযোগপত্রে রাবি শিবিরের তৎকালীন সভাপতি শামসুল আলম গোলাপকে প্রধান আসামী করে হুকুমের আসামী করা হয় বাংলাদেশ জামায়াতেইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদ, প্রখ্যাত মুফাস্সিরে কোরআন জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, রাজশাহী মহানগর জামায়াতের আমীর আতাউর রহমান, মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারী আবুল কালাম আযাদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে। এছাড়াও তৎকালিন রাবি সেক্রেটারি মোবারক হোসেন, বর্তমান সেক্রেটারি সাউফুদ্দীন ইয়াহিয়াসহ মোট ১১০ জন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। (সূত্র: যায়যায়দিন, ৩১ জুলাই ২০১২)
তার মানে দাড়ায়, একটি গণসংগঠনের সর্বোচ্চ নেতারা সবাই মিলে ঢাকা থেকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনের অপরিচিত একজন কর্মীকে হত্যা করার জন্য পরিকল্পনা করেছেন, চেষ্টাও করেছেন। এটা বিশ্বাস করার জন্য কোন পাগলকেও কি পাওয়া যাবে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে? একটা পাগলও যা করতে পারেনা আমাদের বর্তমান সরকার তা করতে পারেন অবলীলায়।
সন্দেহের অবকাশ আছে কি?
আগেই বলেছি, শুধু হত্যা কেন যে কোন নির্যাতনের ঘটনাই কাম্য নয়। ছাত্রদের অধিকার হরণ করে এমন প্রত্যেকটি ঘটনায় ছাত্রশিবির ছিল প্রতিবাদী। তাইতো ফারুক হত্যার নিন্দা জানিয়ে এর বিচারও দাবি করে ছাত্রশিবির। কিন্তু যেখানে ক্ষমতার নৌকা ভাসাতে ছাত্রদের বলিরপাঠা বানিয়ে সৃষ্টি করা হয় রক্ত নদী, যেখানে আইন-আদালত-প্রশাসন-গণমাধ্যম সবকিছুই পেশীশক্তির পিঞ্জরে বন্দী, সেখানে নিপীড়িত মানুষের ন্যায় বিচার পাবার আশা করা শুধু দূরাশাই নয় দু:সাহসও বটে। যেখানে বিচারের বানী নিজেই কাঁদে নীরবে নিভৃতে, সেখানে অধিকার হারা মানুষের
বুক ফাটা কান্নার কোন মূল্য আছে কি?
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে ফারুক হত্যা নিশ্চয়ই নতুন কোন ঘটনা নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ বছরের ইতিহাসে প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন মোট ২৬ জন ছাত্র। ২৪তম হত্যাকান্ডের শিকার হন ফারুক। তন্মধ্যে ১৬ জনই ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী! কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, একটি ঘটনারও বিচার এমনকি সুষ্ঠু তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। শুধু ফারুক হত্যা নিয়ে আমাদের দৈনিক গুলোতে যে পরিমাণ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, টিভি চ্যানেলে যে পরিমাণ পিটিসি বা স্টোরী প্রচার করা হয়েছে তার কিয়দংশও যদি পূর্বের হত্যাকান্ডগুলোর ব্যাপারে বরাদ্দ রাখা হত, তাহলে ফারুকের মত হতভাগা মেধাবীদের প্রাণ হয়তোবা নাও ঝরতে পারত।
ফারুক হত্যাকান্ড পরবর্তী সরকারী পদক্ষেপগুলোই এ হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা দেয়। ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর শিবির বিরোধী হুংকার, পুলিশ ব্যবহার করে একযোগে শিবিরকর্মীদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন, শিবিরের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চিরুনী অভিযান,বার বার তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন এবং অবশেষে চার্জশীটে বিস্ময়করভাবে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে এক ঢিলে কত পাখিই না শিকার করা হলো। বহুমুখি ফায়দা লুটার এ ঘৃন্য মানসিকতাই কি বলে দেয় না ফারুক হত্যার পেছনের মূল কারণ কি?
অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঘটনার পেছনে লুকায়িত সত্যকে জাতির সামনে তুলে ধরা গণমাধ্যমের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু ফারুক হত্যাকান্ডের পর শিবিরকে দোষারোপের ক্ষেত্রে আমাদের গণমাধ্যমগুলো যতটা সোচ্চার ছিল ঠিক ততটাই নীরব ছিল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবির ক্ষেত্রে। কিন্তু কেন? একটি দূর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে অপরাজনীতি ও বহুমুখি ফায়দা লুটার হীন প্রবণতা দেখে কিভাবে চুপ থাকতে পারেন জাতির বিবেক বলে খ্যাত সাংবাদিকেরা? এক ফারুকের প্রাণ বিসর্জনের পর যেখানে হাজার ফারুকের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের দাবিই মূখ্য হবার কথা, সেখানে লক্ষ লক্ষ ফারুকের জীবনে আঁধারের শামিয়ানা নামতে দেখে, স্বপ্ন-সাধ ধুলায় মিশতে দেখেও কিভাবে নীরব থাকে আমাদের গণমাধ্যম, তা আমাদের বুঝে আসেনা।
অসমাপ্ত জুলাই বিপ্লব পূর্ণ করুন : মাহমুদুর রহমান
বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা নয় সম্পদ
কথা বললে গ্রেপ্তার, প্রতিবাদ করলে গুম আর রাজপথে নামলে গুলি - এই নিয়মে মিশরে ৩০ বছর স্বৈরশাসন চালান হোসনি মোবারক।
গণঅভ্যুত্থানোত্তর সময়েও জাতীয় কবির জন্মজয়ন্তী উদযাপনের দায়সারা প্রস্তুতি!