যাকাত আরবি শব্দ। যার অর্থ পবিত্র করা। বা পরিশুদ্ধ করা। আরবিতে যাকাতুল মাল বা "সম্পদের যাকাত" বলা হয়। সেটা নগদ অর্থ হোক আর অবসর পড়ে থাকা সম্পদ হোক। অবসর থাকা সম্পদ যেমন স্বর্ণ রৌপ্য।
শরিয়তের পরিভাষায় যাকাত হলো ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের একটি। প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর রাস্তায় প্রদান করার নাম যাকাত। তবে সেই সম্পদ ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত নিসাব পরিমাণ হতে হবে। ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে নামায, রোযা ও হজ্ব হলো শারিরীক ইবাদত। আর কালেমা আত্মিক এবং যাকাত আর্থিক ইবাদত। অর্থ দিয়ে শরীর মন ও সম্পদকে পরিশুদ্ধ করা। কাউকে সহযোগিতা করাও বলা যেতে পারে। আল্লাহ সবাইকে সব দিক দিয়ে সমান করেননি। কাউকে সুন্দর রং দিয়েছেন কাউকে, সম্পদ বেশি দিয়েছেন কাউকে শান্তির জীবন দিয়েছেন, কাউকে সন্তান সম্পদ উভয়টা দিয়েছেন,কিন্তু মাতাপিতাকে তুলে নিয়েছেন। এভাবে সবাইকে একভাবে না একভাবে দিয়ে ভরপুর করে রেখেছেন।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যার মধ্যে নিহিত আছে মানব জীবনের যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। আর অর্থনৈতিক সমস্যা মানব জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দু’টি প্রধান অর্থনৈতিক মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। পুঁজিবাদ বা ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রি অর্থব্যবস্থা। এ্যাডম স্মীথের হাত ধরে যে পুঁজিবাদের যাত্রা তাতে শুধুই ব্যক্তিস্বার্থ ও ইন্দ্রিয় পরায়ণতার গন্ধ। সমাজের হতদরিদ্র বা বঞ্চিতদের জন্য ছাড় দেওয়ার কোন সুযোগ সেখানে নেই। কারণ বর্তমান অর্থ ব্যবস্থা দরিদ্রকে দরিদ্র করে রাখে বা আরো দরিদ্র করে। আর পুঁজিপতকে আরো পুঁজিপতি বা সম্পদশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই দুইয়ের মাঝে যাকাত ব্যবস্থা চালু না থাকায় এই বৈষম্য চলতে থাকে। আদর্শিকভাবে এই দুই বিপরীত মেরুর বিরুদ্ধেই ইসলামের অবস্থান। সুতরাং ইসলামী অর্থনীতি উল্লিখিত দুই অর্থনীতির আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মকৌশলের দিক থেকে ভিন্ন। যেমন-
(ক) ইসলামী অর্থনীতির মূল উৎস হল কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। অপরদিকে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা মানব রচিত। এ্যাডম স্মিথ, রিকার্ডো, মার্শাল, কার্লমার্কস, লেলিন প্রমুখ অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক এসব অর্থব্যবস্থার প্রবক্তা। কোরআনে বলা হয়েছে ধনীর সম্পদে বঞ্চিত দরিদ্রদের সম্পদ রয়েছে। তাদেরটা তাদের দিয়ে দাও। আর তা হলো যাকাত।
ইসলাম চালু করেছে যাকাত ব্যবস্থা। সম্পদ নির্ধারিত সীমার অধিক আরবী ১ বছর ধরে নিজের আয়ত্বে থাকলে মোট সম্পত্তির ২.৫ শতাংশ (২.৫%) বা ১/৪০ অংশ যাকাত প্রদান করতে হবে।
সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ এক বছর থাকলে যাকাত ফরজ হয়। প্রতি তোলা সমান ১১.৬৬ গ্রাম। সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ মানে ৭.৫ × ১১.৬৬ গ্রাম = ৮৭.৪৫ গ্রাম। অর্থাৎ, সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ প্রায় ৮৭.৪৫ গ্রাম হয়। হিসাব মতে এক ভরি সমান ১১.৬৬ গ্রাম হয়। তাহলে এক ভরি সমান তোলা হিসাব করা হয়। সুতরাং কারো কাছে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ এক বছর তার মালিকানায় থাকলে তিনি যাকাত দিবেন। ভরি হলো ওজন মাপার এক পুরোনো একক, যা মূলত স্বর্ণ-চাঁন্দির ওজন মাপার জন্য ব্যবহৃত হতো। আমাদের দেশে স্বর্ণের ও নগদ টাকার দাম বেশি তাই স্বর্ণের ও টাকার যাকাত হিসাব করা হয়। যে সব দেশে রৌপ্যের দাম বেশি সে সব দেমে রৌপ্যের ৭.৫ ভরি হিসাবে যাকাত আদায় করতে হবে। যেমন আমাদের দেশে এখন স্বর্ণের দাম ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। কারো কাছে সমপরিমান টাকা মানে ১০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা এক বছর জমা থাকে সে যাকাত দাতা হিসেবে গন্য হবেন। কেউ যদি রৌপ্য হিসাব করেন তাহলে তিনি সাড়ে ৭ তোলা মানে সাড়ে সাত ভরি রুপার দাম অনুযায়ী যাকাত দিবেন। যেমন এক ভরি রুপার দাম ২৫৮০ সুতরাং সাড়ে সাত মানে ১৯৩৫০/ টাকা সম পরিমান হয়। তবে আমাদের দেশের আলেমগণ মাসআলা দিয়েছেন কারো কাছে নগদ এক লক্ষ টাকা জমা থাকলে তিনি যাকাতের আওতায় আসবেন। সুতরাং কেউ এ বিষয়কে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।
ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে হজ্জ্ব এবং যাকাত শুধুমাত্র শর্তসাপেক্ষ যে, তা সম্পদশালীদের জন্য ফরজ বা আবশ্যিক। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে "যাকাত" শব্দের উল্লেখ এসেছে ৩২ বার। নামাজের পরে সবচেয়ে বেশি বার এটি উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, "আর তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর’। [ সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত ২০]
কোন নিসাবধারী মুসলিমের নিজ পরিবারের প্রয়োজনীয় আয়ব্যয় মিটিয়ে বছরান্তে যদি ন্যূনতম পক্ষে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা তার সমপরিমাণ অর্থসম্পদ জমা থাকে, উক্ত অর্থসম্পদ হতে শতকরা ২.৫ আড়াই শতাংশ হারে যাকাত দিবেন। কাকে দিবেন? আট ধরনের লোকদেরকে যাকাত দিবেন। তারা হলো:
১.ফকির,
২.মিসকিন,
৩.যাকাত আদায়কারী কর্মচারী,
৪.নওমুসলিম,
৫. দাসমুক্ত করা,
৬.ঋণগ্রস্ত,
৭.আল্লাহর পথে ব্যয়কারী এবং
৮.মুসাফির।
এদের বাইরে কি কোনো অভাবী দরিদ্র থাকতে পারে?
আরও বিস্তারিতভাবে বলা যায়:
১. ফকির: যাদের কোনো সম্পদ নেই বা যাদের সম্পদ খুবই সামান্য, তারা হলো ফকির।
২. মিসকিন: যাদের সামান্য সম্পদ আছে, কিন্তু তা তাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়, তারা হলো মিসকিন।
৩. যাকাত আদায়কারী কর্মচারী: যারা যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে সাহায্য করে, তাদেরও যাকাতের কিছু অংশ দেওয়া যেতে পারে।
৪. নওমুসলিম: ইসলাম গ্রহণ করার পর ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত আছে, দ্বীন মেনে চলে যারা, তাদের সাহায্য করা যেতে পারে।
৫. দাসমুক্ত করা: দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যবহার করা যেতে পারে। এখন তো দাসত্বের প্রথা নেই, সুতরাং দ্বীনের কাজে কারাগারে যাওয়া ব্যক্তিদের মুক্ত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৬. ঋণগ্রস্ত: যারা ঋণগ্রস্ত, তাদের ঋণ পরিশোধ করতে সাহায্য করা যেতে পারে। তাতের মধ্যে ভাই বোন প্রাধান্য পেতে পারে। মুসলিম ও আল্লাহর রাস্তায় কাজ করার লোককে দেওয়া যেতে পারে।
৭. আল্লাহর পথে ব্যয়কারী: যারা আল্লাহর পথে কাজ করে, যেমন - শিক্ষা, চিকিৎসা, গবেষণা ইত্যাদি, তাদের সাহায্য করা যেতে পারে।
৮. মুসাফির: যারা ভ্রমণে বের হয়েছে কিন্তু কোনো কারণে অর্থ খোয়া গেছে, চুরি হয়েছে বা হারিয়েছে। এমন যে কোন কারণে বিপদে পড়েছে ফেরত যাওয়ার অর্থ নেই, তাদের সাহায্য করা যেতে পারে।
যাকাতের অর্থ বিশেষভাবে এই ৮টি খাতে ব্যয় করা উচিত, কারণ কুরআন ও সুন্নাহতে এগুলোর উল্লেখ আছে।
যাকাত দানের উপযুক্ত হলে যাকাত আদায় করা উচিত। নিয়ম হলো নিজে যাকাতের অংশ পৌছে দেয়া। এটা নিজের দায়িত্ব মনে করা। আল্লাহ সবাইকে সুখে রাখার জন্য এই পদ্ধতি চালু করেছেন। সবার সম্পদে গরীবের হক আছে এটা মনে রাখতে হবে।
একবার এক লোক এসে এক হুজুরের কাছে বললেন হুজুর আল্লাহ আমাকে সম্পদশালী করা থেকে বিমুখ রয়েছেন। হুজুর বললেন আসতাগফেরুল্লাহ বলুন। তিনি অবাক হয়ে বললেন গত বছর আমার রোজগার থেকে আমি কিছু সঞ্চয় করতে পেরেছি এবছর তা পারছি না। তখন হুজুর বললেন তুমি সুস্থ আছো? বললো আছি, বললেন তোমার পরিবারের লোকদেরকে এ বছর কয়বার হাসপাতালে নিতে হয়েছে? বললো না একবারও না। হুজুর বললেন, এটাই তোমার সঞ্চয়। আল্রাহ তোমাকে সুখে রেখেছেন। পেরেশানীতে রাখেননি এটাই সঞ্চয়। এর যাকাত হলো আসতাগফেরুল্লাহ বেশি বেমি পড়বে। আলহামদুলিল্লাহ বলে শুকরিয়া আদায় করবে।
হজরত আবু বকর (রা.) বলেন- আল্লাহর শপথ! তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আমি যুদ্ধ করবো, যারা সালাত ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে। কেননা জাকাত হলো সম্পদের ওপর আরোপিত হক। আল্লাহর কসম, যদি তারা একটি মেষশাবক জাকাত দিতেও অস্বীকৃতি জানায়, যা রাসূল (সা.)-এর কাছে তারা দিত, তাহলে জাকাত না দেওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করবো। ‘ওমর (রা.) বলেন-আল্লাহর কসম, আল্লাহ আবুবকর (রা.)-এর হৃদয় বিশেষ জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করেছেন বিধায় তার এ দৃঢ়তা। এতে আমি বুঝতে পারলাম তার সিদ্ধান্তই যথার্থ। (মুসলিম ১/৮, হা: ২০, আহমাদ ২৪, ১০৮)
জাকাত শুধু দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার নয়, বরং এটি সামাজিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে শক্তিশালী করে। তাই বলা যায়, জাকাত একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, যা দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও বৈষম্য দূর করে একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। জাকাতের সঠিক প্রয়োগই পারে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে আলোকিত একটি ভবিষ্যৎ গড়তে।
আমাদের দেশের মসজিদ গুলোতে জুমার দিন দান বাক্সে কত টাকা উঠলো তার হিসাব কমিটি ঠিকই নেয়, এবং সপ্তাহে মসজিদের মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে ঘোষনা করতে হয়। অথচ বছরে কত টাকা ট্যাক্স আদায় হয় তার হিসাবটা গুগলে সার্চ দিলে পাবেন না। অর্থনীতিবিদদের মতে, বছরে ১ লাখ কোটি টাকার যাকাত আদায় করা সম্ভব। যদি তাই হয় তাহলে দেশে কি অভাব থাকবে? গরীব থাকবে? বিদেশী অর্থ সাহায্য আসতে হবেনা বরং সবাই ধনী হয়ে যাবে। শত শত কোটি টাকা দেশের কিছু লোকের আলমিরাতে পড়ে থাকে। নর্তকী মমতাজের ঘরে ৯০০ কোটি টাকা নগদ পাওয়া গেলে বড় বড় ধন কুমীরদের গচ্ছিত কত আছে? ১% সম্পদের ট্যাক্স সঠিকমতো আদায় করা হলে বাংলাদেশের জন্য আর কিছু লাগবে না। ঘোষনা করে সব ব্যবসায়ীকে বাধ্যতা মূলক ট্যাক্সের অধীনে আনা হোক। সব ব্যবসায়ীর বিন নাম্বার থাকুক। ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের আগে তার টিন বিন পরীক্ষা করা হোক। ১% করে জমা দিক। সরকার কারো কাছে সাহায্য চাইতে হবে না। একজন পান দোকানদারেরও ১% ট্যাক্স দিতে হবে। সে একশত টাকা দিক কিন্তু তার নামে লাইসেন্স থাকতে হবে। কেউ হেটে হকারী করতে পারবে না। দেশের চেহারাই বদলে যাবে। সবার সম্পদের হিসাব সরকারের কাছে থাকতেই হবে। ট্যাক্সের নাম থাকবে যাকাত বিভাগ। আরো কয়েক হাজার লোক নিয়োগ দিবে। তাদের সবার কাজ হবে সব দোকানদার যাকাত দিচ্ছে কি না তা চেক করা। সরকারই যাকাত আদায় করবে। লোকজন যখন দেখবে যাকাতের ব্যবহার তার প্রতিবেশির ঘরে পৌছে গেছে। সে স্বেচ্ছায় যাকাত পান্ডে টাকা জমা দেবে। বর্তমানে বৃদ্ধ / বয়স্ক ভাতাও খেয়ে পেলে নেতারা। গ্রামের বয়স্করা ভাতা ঠিকমতো পায় না। কোনো দান গেলে তা পায় না। সব দল মিলে কমিটি হবে, কারো জানার বাইরে কেন দান অনুদান এলাকায় যাবে না। সব ইউনিয়নের মাধ্যমে বিলি হবে। ছোট হোক বড় হোক যার দূর্নীতি প্রকাশিত হবে তার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। যাকাত আদায় এবং বিলি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই দেশ হবে স্বনির্ভর।