ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে শত শত কোটি টাকার নতুন নোট সরবরাহ করেছে। তবে এই নতুন টাকা সাধারণ জনগণের হাতে পৌঁছানোর বদলে পৌঁছে গেছে খোলাবাজারের সিন্ডিকেটের কাছে—এমনই চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
নতুন নোট পেতে গিয়ে ব্যাংকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও হতাশ হয়ে ফিরেছেন বহু গ্রাহক। অন্যদিকে, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতের দোকানে রমরমা হারে বিক্রি হচ্ছে নতুন টাকা—তাও দ্বিগুণ দামে।
গতকাল ও আজ রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, কৃষি ও ইসলামী ব্যাংকের বেশ কয়েকটি শাখা ঘুরে দেখা গেছে, নতুন টাকা বিতরণের দৃশ্য নেই। কোথাও ঘোষণা টানানো হয়নি, কোথাও আবার লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও গ্রাহকরা ফিরে গেছেন খালি হাতে।
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, চলতি বছর ঈদ উপলক্ষে মোট ৫২০ কোটি টাকার নতুন নোট ছাপানো হয়েছে। এগুলো দেশের প্রায় সব ব্যাংকেই সরবরাহ করা হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যত টাকা পেয়েছি, তা দিয়ে কাস্টমারদের চাহিদা মেটানো সম্ভব না। যে কারণে অনেক শাখাতেই বিতরণই করা হয়নি।”
অগ্রণী ব্যাংকে ৪ ঘণ্টা অপেক্ষার পর মাত্র ১০ হাজার টাকার নতুন নোট পাওয়া গ্রাহক আল-আমিন বলেন, “তাও আবার আগের সরকারের আমলে ছাপানো টাকা। বর্তমান সরকারের ছাপানো নোটই দেয়নি!”
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনের ফুটপাতে অন্তত ডজনখানেক বিক্রেতা খোলামেলা অবস্থায় নতুন নোটের বান্ডিল নিয়ে বেচাকেনা করছেন। ২০ টাকার বান্ডিল ৩,৫০০ টাকায় (মূল্য ২,০০০), ৫০ টাকার বান্ডিল ৭,০০০ টাকায় (মূল্য ৫,০০০), আর ১০০ টাকার বান্ডিল ১১,০০০ টাকায় (মূল্য ১০,০০০) বিক্রি হচ্ছে।
এই বিক্রেতাদের কারও কাছে দেখা গেছে ৪-৫ লাখ টাকার নতুন নোট। বিক্রি শেষ হয়ে গেলে নতুন করে “স্টক” এনে আবার বসে পড়ছেন বিক্রয়ে।
একজন বিক্রেতা বলেন, “ব্যাংকে তো আর পাবেন না ভাই, আমাদের কাছেই আসতে হবে। যা চাহিদা, ব্যাংক সামাল দিতে পারে?”
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “আমরা সপ্তাহের শুরু থেকেই নতুন নোট সরবরাহ করেছি। কিন্তু অনেক ব্যাংকই তা যথাযথভাবে বিতরণ করেনি।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “অধিকাংশ ব্যাংক নিজেরা নোট রেখে দিয়েছে, আবার কিছু অসাধু কর্মকর্তা খোলাবাজারে ছেড়ে দিয়েছেন বেশি দামে বিক্রির জন্য। এমনকি আমাদেরও আত্মীয়স্বজনদের দিতে পারিনি!”
তিনি আরও জানান, এবছর ব্যক্তিপ্রতি সর্বোচ্চ ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত নতুন নোট দেয়া হচ্ছে, যেখানে আগের বছরগুলোতে তা ছিল ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, পরিস্থিতি বিবেচনায় শিগগিরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ব্যাংকগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হবে এবং যেসব ব্যাংক বা কর্মকর্তা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
“যদি ভবিষ্যতে ফুটপাত বা বাজারে নতুন টাকা পাওয়া যায়, তাহলে স্পষ্টভাবে তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দায়িত্বে পড়বে। প্রয়োজনে লাইসেন্স স্থগিতের মতো ব্যবস্থা নেব,” বলেন ওই কর্মকর্তা।
নতুন টাকার মতো একটি ছোট খাতে দুর্নীতি ও অদক্ষতা যদি প্রকাশ্য হয়ে পড়ে, তাহলে বৃহৎ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এর প্রভাব কতটা গভীর—সে প্রশ্নও তোলেন অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, এই ধরনের অসংগঠিত দুর্নীতির সুযোগ বন্ধে দরকার প্রযুক্তি নির্ভর স্বয়ংক্রিয় বিতরণ ব্যবস্থা ও নিয়মিত নজরদারি।
ঈদকে কেন্দ্র করে যে আনন্দময় আবহ তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তা যেন নতুন নোটের এই ‘কালোবাজারি সিন্ডিকেটে’ বিষিয়ে উঠছে। মানুষ ব্যাংকে গিয়ে খালি হাতে ফিরছে, অথচ রাস্তার পাশে বসে কেউ কেউ লাখ লাখ টাকার বান্ডিল গুনছে। এ চিত্র শুধু অর্থনৈতিক নয়, নৈতিক দিক থেকেও রাষ্ট্রের জন্য একটি অশনিসংকেত।