পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত পরম আনন্দের একটি দিন। এটি শুধু একটি উৎসব নয়; এটি মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক মহৎ মাধ্যম। কোরবানি মানে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর প্রতি উৎসর্গ করে ত্যাগ ও তিতিক্ষার দৃষ্টান্ত পেশ করা। ঈদুল আজহার দিন থেকে শুরু করে দ্বাদশতম দিন পর্যন্ত, যেসব মুসলমানের কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তাদের ওপর কোরবানির ওয়াজিব কর্তব্য আরোপিত হয়।
ঈদুল আজহায় পালনীয় ১৩টি বিশেষ সুন্নাহ
১. সকালে জাগ্রত হওয়া : অন্যদিনের তুলনায় ঈদের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। (বায়হাকি : ৬১২৬)
২. গোসল করা ও পবিত্রতা অর্জন করা : ঈদের নামাজের জন্য গোসল করা ও মিসওয়াক করা সুন্নত। হাদিস বর্ণিত আছে, ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ঈদুল ফিতর ও আজহার দিন গোসল করতেন। (বোখারি : ১/১৩০)
৩. সুন্দর ও উত্তম পোশাক পরিধান করা : মুসলমানদের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসব তথা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর এবং সাধ্যের ভেতর সবচেয়ে উত্তম পোশাক পরিধান করা সুন্নত। ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেছেন, নবীজি দুই ঈদের দিন সবচেয়ে সুন্দর ও উত্তম জামাটি পরিধান করতেন। তার একটা বিশেষ স্যুট ছিল, যা তিনি দুই ঈদে ও জুমায় পরতেন। হাদিস বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) প্রতিটি ঈদে ডোরা-কাটা পোশাক পরিধান করতেন। (বায়হাকি : ৬৩৬৩)
৪. ঈদগাহে যাওয়ার আগে পানাহার থেকে বিরত থাকা : ঈদুল আজহার দিন পানাহার ছাড়া ঈদগাহে যাওয়া ও নামাজের পর নিজের কোরবানির গোশত দিয়ে প্রথম খাবার গ্রহণ করা সুন্নত। নবী করিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন না খেয়ে ইদগাহে যেতেন না। আর কোরবানির দিন নামাজের আগে খেতেন না। (তিরমিজি : ৫৪২)
৫. ঈদগাহে যাওয়ার সময় তাকবির বলা : ঈদের দিন বেশি বেশি তাকবির পাঠ করে আল্লাহকে ডাকার মধ্যেই প্রকৃত আনন্দ। ইদগাহে যাওয়ার সময় ও ঈদের দিন পুরুষরা উচ্চ স্বরে তাকবির পাঠ করবে। আর মেয়েরা পাঠ করবে নীরবে। পবিত্র কোরআনে কারিমে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন—‘যাতে তোমরা গণনা পূর্ণ কোরো এবং তোমাদের হেদায়াত দান করার দরুন আল্লাহতায়ালার মহত্ত্ব বর্ণনা করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)
জিলহজের ৯ তারিখ ফজরের পর থেকে ১৩ তারিখ আসরের সালাত পর্যন্ত—পাঁচ দিন তাকবির পাঠ করবে। (হিদায়া ও ফাতহুল বারি : ২/৫৮৯)
৬. ঈদগাহে আসা-যাওয়ার রাস্তা পরিবর্তন করা : ঈদগাহে যাতায়াতের রাস্তা পরিবর্তন করা সুন্নত। যাওয়ার সময় এক রাস্তা দিয়ে গমন করা এবং ফেরার সময় অন্য রাস্তা ব্যবহার করা সুন্নত। জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবীজি (সা.) ঈদের দিন ঈদগাহে আসা-যাওয়ার রাস্তা পরিবর্তন করতেন। (বোখারি : ৯৮৬)
৭. হেঁটে ঈদগাহে গমন করা : কোনো ধরনের অপারগতা ও অক্ষমতা না থাকলে, হেঁটে ইদগাহে যাওয়া সুন্নত। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) হেঁটে ঈদগাহে গমন করতেন এবং হেঁটে ঈদগাহ থেকে ফিরতেন। (তিরমিজি : ১২৯৫)
৮. ঈদগাহে শিশুদের নিয়ে যাওয়া : আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) দুই ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার সময় ফজল ইবনু আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস, আব্বাস, আলি, জাফর, হাসান, হোসাইন, উসামা ইবনু জায়েদ, জায়েদ ইবনু হারিসা, আয়মান ইবনু উম্মু আয়মান (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে উচ্চ স্বরে তাকবির ও তাহলিল পাঠ করতে করতে বের হতেন। অতঃপর তিনি কামারদের রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে উপস্থিত হতেন এবং ফেরার সময় মুচিদের রাস্তা দিয়ে ঘরে আসতেন। (বায়হাকি : ৬৩৪৯)
৯. ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা : ঈদের দিন একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে শুভেচ্ছা বিনিময় করা সুন্নত। হাদিসে বর্ণিত আছে, জুবাইর ইবনু নুফাইর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বলতেন ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’—আল্লাহ আমার ও আপনার যাবতীয় ভালো কাজ কবুল করুক। (ফাতহুল কাদির : ২/৫১৭)
১০. ঈদের খুতবা শোনা : ঈদের নামাজের পর খুতবা দেওয়া সুন্নত। আর উপস্থিত মুসল্লিদের ওপর তা শোনা ওয়াজিব। আবদুল্লাহ ইবনু সায়িব বর্ণনা করেছেন, নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে আমি ঈদগাহে উপস্থিত হয়েছি। তিনি আমাদের নামাজ পড়িয়েছেন। অতঃপর তিনি বললেন : ‘আমরা নামাজ শেষ করেছি। যার ইচ্ছা সে খুতবা শোনার জন্য বসবে। আর যে চলে যেতে চায়, সে চলে যাবে।’ (ইবনু মাজাহ : ১০৭৩)
কোরবানির পশু জবাইয়ের সুন্নত
১. সুন্দরভাবে জবাই করা : কোরবানির পশু জবাই করার যন্ত্র ভালোভাবে ধার দেওয়া, প্রাণীকে সুন্দরভাবে জবাইয়ের স্থানে নিয়ে যাওয়া ও উত্তমভাবে জবাই করা মুস্তাহাব। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করাকে আবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা কাউকে হত্যা করলে ভালোভাবে কোরো। জবাই করলে উত্তম পন্থায় জবাই কোরো। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধার করে নেয় এবং তার জবাই করা পশুকে আরাম দেয়।’ (মুসলিম : ৫১৬৭)
২. পারলে নিজে জবাই করা : জবাইয়ে পারদর্শী হলে নিজের কোরবানির পশু নিজেই জবাই করা সুন্নত। অপারগ হলে অন্য মুসলিমকে দায়িত্ব দেওয়া উত্তম। জবাইকারীর মুখ কেবলার দিকে থাকা এবং ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে জবাই করা মুস্তাহাব। আনাস (রা.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) ভেড়ার পাশের ওপর পা রেখে আল্লাহর নামে নিজ হাতে জবাই করেছেন। (বোখারি : ৫২৩৮) বর্ণিত আছে, ‘এক শ উটের মধ্যে ষাট বা তার বেশি উট নিজ হাতে জবাই করেন। বাকিগুলো জবাই করতে আলী (রা.)-এর কাছে দেন।’ (মুসলিম : ৩০০৯)
ঈদ হোক মুসলিম উম্মাহর অনাবিল সুখ-শান্তি ও চিরস্থায়ী মুক্তির সোপান।
লেখক : মুফতি গোলাম রাজ্জাক কাসেমী
বিভাগীয় প্রধান, আরবি ভাষা বিভাগ, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা