২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ দেশের তরুণ প্রজন্মের ওপর যে ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক ক্ষত তৈরি করেছে, তার করুণ চিত্র উঠে এসেছে একটি সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে। গবেষণাটির তথ্য অনুযায়ী, রাবার বুলেট, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতে অন্তত ৩৮২ জন তাদের দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারিয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই তরুণ, শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী নারী ও গরিব পরিবার থেকে আসা সাধারণ মানুষ। তাদের অনেকে এখনো অন্ধত্ব, ট্রমা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দিন পার করছেন।
প্রতিবেদনটি একটি অন্ধ প্রজন্মের কথা বলে, যাদের চোখ কেবল অন্ধ হয়নি, বরং হারিয়েছে ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন ও আত্মমর্যাদার অনুভব। আন্দোলনে সরাসরি অংশ না নেওয়া অনেক সাধারণ নাগরিকও রাস্তায় বা কর্মস্থলে যাবার পথে এই ভয়াবহ বলপ্রয়োগের শিকার হয়েছেন। শাহরিয়ার, শারমিন, রেশমা, রাসেল, বিজয়, ফাহিম, জান্নাতুল ও তাহমিনার মতো বহু মানুষের গল্প রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বাস্তবতা ও নিষ্ঠুরতার সাক্ষ্য বহন করে।
এত বিপুল সংখ্যক মানুষ চোখ হারানোর পরও রাষ্ট্র কোনো দায় স্বীকার করেনি, নেই কোনো পুনর্বাসন কর্মসূচি বা বিচারিক প্রক্রিয়া। বরং আক্রান্তদের অনেককে হাসপাতাল থেকেও ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে "সরকারবিরোধী" তকমা দিয়ে। হাসপাতালগুলো অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেলেও কর্নিয়া ডোনারের অভাব এবং রাষ্ট্রের সহযোগিতা না থাকায় শত শত মানুষ এখনো অনিরাময়যোগ্য অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, অধিকাংশ গুলি লক্ষ্য করেই চোখে ছোড়া হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিমালার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। এটি শুধু বলপ্রয়োগ নয়, বরং প্রতিবাদ দমন ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আন্দোলন ঠেকাতে তরুণদের শারীরিকভাবে বিকল করে দেওয়ার একটি উদ্দেশ্যমূলক কৌশল।
এই সহিংসতার বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি, হয়নি কোনো রাষ্ট্রীয় তদন্ত। বরং যারা সত্য ধরতে চেয়েছেন, তারাই আজ বিপদের মুখোমুখি। প্রতিবেদনটির মূল বার্তা হলো—রাষ্ট্র তার তরুণদের চোখ উপড়ে নিয়েছে, যাতে তারা আর দেখে প্রশ্ন না তোলে।
এই অন্ধত্ব একদিকে যেমন একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের পরাজয়, তেমনি সমষ্টিগতভাবে গণতন্ত্রের অন্ধকার সময়ের প্রতিফলন। এসব চোখহারা তরুণদের কান্না নিছক ব্যক্তিগত ক্ষত নয়—এটি একটি ভেঙে পড়া রাজনৈতিক নৈতিকতা ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বহীনতার নীরব দলিল।
বাংলাদেশ আজ একটি ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে। চোখ হারানো এই প্রজন্ম আমাদের সামনে এক অনিবার্য প্রশ্ন তোলে: রাষ্ট্র তার নাগরিকদের—বিশেষ করে তরুণদের—স্বপ্ন, মতপ্রকাশের অধিকার ও মানবিক মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে সেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কেমন হবে?
সূত্র:আমার দেশ