বাংলাদেশের জাতীয় কবি, মহা বিদ্রোহী,কবিকূল শিরোমণি,বিশ্বকবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো কবির দৌলতপুর অধ্যায়। একজন বিশ্বযুদ্ধ ফেরত, রুক্ষ মনের মহা বিদ্রোহীকে এখানকার নারীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা তাঁর মানসপটে প্রেমিক কবির বিমূর্ত ছবি এঁকে দিয়েছিল। কুমিল্লার দৌলতপুরে না এলে নজরুলের কবি জীবন ও প্রেমিকজীবন হয়তো পরিপূর্ণ হতো না। দৌলতপুর আসার কারণে নজরুলের জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছিল, তাঁর সাহিত্যচর্চায় যোগ হয়েছিল নতুন মাত্রা।
এখানে এসেই বিদ্রোহী কবি হয়ে গিয়েছিলেন প্রেমের কবি। নার্গিস নামের এক তরুণী তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। নার্গিসের সঙ্গে কবি নজরুলের প্রথম দেখা হয়েছিল খানবাড়ির এক বিয়ে অনুষ্ঠানে। নার্গিসকে প্রথম দেখার পরই বিদ্রোহী কবির মধ্যে প্রেমিক কবির আবির্ভাব ঘটেছিল। তাই তো তিনি লিখেছেন-'এক অচেনা পল্লী-বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে হয়নি।
কবির এই পল্লী-বালিকার নাম সৈয়দা খাতুন। কিন্তু কবি তাকে এই নামে ডাকতেন না। ইরানি ফুল নার্গিস নামে ডাকতেন। এই নার্গিস ফুলই পরবর্তী সময়ে কবির হদয়-বাগান সুরভিত করেছিল।
'নার্গিস! নার্গিস! কেন ফুটলে আমার ফুল-বাগিচায় আনলে মদির সুরভি কেন গাইলে গজল শিরীন-সুর কাঁদলো সাঁঝের পূরবি।'
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজী নজরুল ইসলাম পাকিস্তানের করাচিতে যখন থাকতেন, তখন পরিচয় হয় দৌলতপুরের আলি আকবর খানের সাথে। বিশ্বযুূ্দ্ধো আলী আকবর খান ছিলেন ক্যাপ্টেন আর কবি নজরুল ছিলেন হাবিলদার। সেই সূত্রে তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।দুজনের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। কবি নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে আলী আকবর খান তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নিজের গ্রামের বাড়ি দৌলতপুরে আসতে। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে কবি নজরুল দৌলতপুরে আসেন। পথিমধ্যে কুমিল্লা শহরে আলি আকবর খানের বন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে উঠেছিলেন। এখানে আসার পথে চট্টগ্রাম মেইল টেনে বসে তিনি 'নীলপরী' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
১৯২১ সালের ৬ এপ্রিল কাজী নজরুল ইসলাম দৌলতপুরে আসেন।তাঁর আগমনে ব্যান্ড পার্টি দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা দেওয়া। করা হয়েছিল সুবিশাল গেইট। জমিদার রুপেন্দ্র লোচন মজুমদার কবির আগমনে ভীষণ খুশী হয়েছিলেন। এবঙ যথাযথ সম্মানে বরণ করে নিয়েছিলেন।
দৌলতপুরে আলি আকবর খানের ভাগ্নী নার্গিসের সাথে তাঁর প্রেম ও পরিনয় হয়েছিলো। কাজী নজরুল ইসলামের সাথে নার্গিসে বিয়ের অনুষ্ঠান জমকালো আয়োজনের মধ্যেই হয়েছিলো। সেটা ছিল ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭জুন মোতাবেক ১৩২৮ সনের ৩ আষাঢ়, শুক্রবার। কিন্তু কী এক অজানা কারণে বিয়ের পর রাতেই অভিমানী কবি নজরুল দৌলতপুর ছেড়ে কুমিল্লার কান্দিরপাড় চলে গিয়েছিলেন। কবি তাঁর বিবাহিতা নব বধুকে ছেড়ে একেবারে চলে গিয়েছিলেন।তবে কুমিল্লা থেকে নার্গিসের মামা আলী আকবর খানকে 'বাবা শ্বশুর' সম্বোধন করে তিনি যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে কিছুটা অনুমান করা যায়। তিনি লিখেছেন, 'বাবা শ্বশুর! আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতন ব্যবহার ক'রে এ'সে যা কিছু কসুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে...।... আমি সাধ ক'রে পথের ভিখারী সেজেছি ব'লে লোকের পদাঘাত সইবার মতন 'ক্ষুদ্র-আত্মা' অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এত হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙে দিয়েছে...।'
এই চিঠিই প্রমাণ করে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে নার্গিসের বিয়ে হয়েছিলো।যদিও বিয়ের আরও দালিলিক প্রমাণ রয়েছে।রয়েছে বিয়ের কার্ড।
দৌলতপুরে নার্গিসের বসতবাড়িটা এখন আর নেই।তবে আলী আকবর খানের সেই বাড়িটা আছে। রাজপ্রাসাদের মতো কারুকার্যময় দ্বিতল ভবন। বাড়িটার সামনে আছে পুরোনো আমলের একটা পুকুর। এ পুকুরেই নজরুল ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতেন। একবার পুকুরে নামলে উঠবার নামও নিতেন না। পুকুরের জলে ছোট শিশুদের সঙ্গে লাই খেলতেন। ডুব দিয়ে তাদের কলের গান শোনাতেন। আলী আকবর খানের এক বোন ছিল, নাম ইফতেখারুন্নেছা। নজরুল তাকে মা ডাকতেন। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটা আমগাছ ছিল। সেই জায়গাটা এখনও স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখা আছে। ইফতেখারুন্নেছা এই আমগাছের তলায় খাবার নিয়ে এসে নজরুলকে ডাকতেন 'আয় নুরু, খেতে আয়!' তখন নজরুল ভদ্র ছেলের মতো গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন। এই আমগাছের নিচে বসেই নজরুল রাতদুপুরে মনভোলানো উদাস সুরে বাঁশি বাজাতেন। দুপুরে শীতল পাটিতে বসে কবিতা ও গান রচনা করতেন। আমগাছের পাশেই ছিল কামরাঙা, কামিনী, কাঁঠালগাছের সারি। এখানে তিনি খানবাড়ি ও দৌলতপুর গ্রামের ছেলেমেয়েদের নাচ, গান, বাদ্য শেখাতেন। গাছ গুলো কয়েক বছর আগে মারা গেছে। তবে আমগাছের গোড়া এখনো পাকা করে রাখা হয়েছে। আমগাছটা ছাড়াও তখন খানবাড়িতে বারোটা কামরাঙাগাছ ছিল। কবির শোবার ঘরের সামনে ছিল একটি কামরাঙাগাছ, যা তার অনেক কবিতা গানে, হাসি-কান্না, মান অভিমান এবং মিলন-বিরহের নীরব সাক্ষী। এই গাছকে নিয়েই তিনি লিখেছেন-'কামরাঙা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে হায় কে দেবে দাম...।'
কাজী নজরুল ইসলাম মাঝেমধ্যে দুপুরবেলায় এই গাছের শীতল ছায়ায় বসে আপন মনে গান গাইতেন, গান রচনা করতেন। সেই গাছটা এখনো আছে। নজরুল স্মৃতি ধরে রাখতে গাছটাতে ফলক বানানো হয়েছে। নজরুল যখন বিকেলবেলায় এই গাছের ছায়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে বসে কবিতা ও গান লিখতেন তখন নানা কাজের ছলে এখানে ছুটে আসতেন নার্গিস। আর তখনই নজরুল-নার্গিসের মন দেওয়া-নেওয়ার ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।
কাজী নজরুল ইসলাম ৭৩ দিন ছিলেন দৌলতপুরে। সেই সময়ে তিনি ১৬০টা গান ও ১২০টা কবিতা লিখেছিলেন। 'পাপড়ি-খোলা' নামের বিখ্যাত কবিতাটাও লিখেছিলেন এখানে বসে। এছাড়াও 'অ-বেলায়', 'অনাদৃতা', 'বিদায়-বেলায়', 'হারমানা-হার', 'হারামণি', 'বেদনা অভিমান', 'বিধুরা পথিক প্রিয়া' কবিতাগুলো লিখেছিলেন।
সাম্যের কবি,মানবতার কবি, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সারাজীবন লড়ে যাওয়া কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাকে নিয়ে জাতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আজও তাঁর তীর্থ ভুমি কবিতীর্থ দৌলতপুর কে নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়। ১৯৮১ সালে দৌলতপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় " নজরুল নিকেতন "। দীর্ঘ ৪৩ বছর নজরুল নিকেতন অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে কবিতীর্থ দৌলতপুর কে জাতীয় ভাবে প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের নজরুল চর্চা কে বেগবান করতে। কিন্তু আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্র এবঙ কাজী নজরুল ইসলামের মুসলিম স্ত্রী কে অস্বীকার করার হীনমন্যতা একটি জাতীয় কবির তীর্থভূমি কে বারবার অসম্মান করা হচ্ছে এবঙ আজও জাতীয় ভাবে দৌলতপুরে নজরুল চর্চার তেমন কোন সুযোগ সৃষ্টি হয় নি।
নিন্দার কাঁটা ও আদর্শবাদী এক্টিভিজম - ওয়াজ কুরুনী সিদ্দিকী
কা'বা দর্শণ আল্লাহর এক নিয়ামত : অধ্যাপক আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন
যাকাত ও সাদাকা : দারিদ্র্য বিমোচনের মানবিক সমাধান
যাকাতের মাধ্যমেই দেশ হতে পারে স্বনির্ভর - আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন