ঈদ শব্দের অর্থ খুশি বা আনন্দ। আর আয্হা অর্থ ত্যাগ বা কুরবানী। একত্রে ঈদ-উল আয্হা হলো ত্যাগ বা কুরবানীর আনন্দ। কথায় বলে, ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। মা-বাবা নিজেদেরকে বঞ্চিত রেখে, সন্তানের আহার জুগিয়ে আনন্দ পায়। প্রিয়জনকে উপহার দিতে ভাল লাগে। ত্যাগী মানুষেরা অপরকে দিয়েও অনাবিল আনন্দ লাভ করে। এ আনন্দ তুলনাহীন।
ঈদ-উল-আয্হা প্রকৃত পক্ষে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর মহান স্মৃতিকে বহন করে। পবিত্র কুরআনে তার সম্পর্কে “মিল্লাতে আবি কুম ইবরাহীম” তথা মুসলিম জাতির পিতা বলা হয়েছে। সমাজের সর্ব প্রথম স্তর হলো পরিবার। সমাজ বহুসংখ্যক পরিবারের সমষ্টি। মুসলিম জাতির পরিবারের বৈশিষ্ট্য এবং স্বরূপ কেমন হবে তারও দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন এ জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ)।
মৌলিক আদর্শ সম্পর্কে মতভেদ থাকলে ঔরসজাত সন্তান এবং বিবাহিত স্ত্রী নিয়েও কোন আদর্শ নিষ্ঠ পরিবার গঠিত হতে পারে না। মুসলিম পরিবারের সদস্যবৃন্দ পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয় আদর্শ ও বিশ্বাসের বন্ধনীতে।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্ত্রী হাজেরাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে কাজটি মনে হবে নিষ্ঠুর ও অমানবিক। কিন্তু কী তার কারণ? কারণ একটাই, তা ছিল মহান স্রষ্টার নির্দেশ।
স্ত্রী হাজেরা যখন শুনলেন, আল্লাহর ইচ্ছাতেই তিনি নির্বাসিত হচ্ছেন তখন তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিলেন সে সিদ্ধান্ত। কেননা যে আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহীম (আঃ) নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ও গভীর বেদনা নিয়ে স্ত্রীকে নির্বাসন দিচ্ছেন সে আল্লাহকে বিবি হাজেরাও গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। তাই তিনি প্রশান্ত মনে জনমানবহীন মক্কায় নির্বাসন মেনে নিলেন।
নিজের নিরাপত্তার চিন্তার চেয়ে স্বামীর ব্যথিত চিত্তকে শান্ত করার আগ্রহই ছিল প্রবল। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আল্লাহর ইচ্ছাতে যখন নির্বাসিত হয়েছেন তখন আল্লাহই তাকে রক্ষা করবেন। বস্তুত এ নির্বাসনের নিভৃতে লুকায়িত ছিল মহান আল্লাহর বিশেষ লক্ষ্য। তাইতো তিনি নির্বাসিত হাজেরাকে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের থাবা থেকে শুধু যে রক্ষা করেছিলেন তা নয়; নির্জন পাহাড়ে সৃষ্টি করেছিলেন জমজম প্রস্রবণ-যার পানিধারা শুধু ইসমাঈল (আঃ) আর বিবি হাজেরার প্রয়োজনই মেটায়নি বরং আজও তা বিশ্ব মুসলিমকে তৃপ্ত করে। মা হাজেরা যদি আদৌ নির্বাসিত না হতেন তবে আদ্যবধি হয়তো মক্কায় মানুষের আবাদ হতো না। আব্দুল্লাহর কুটিরে জন্ম নিতেন না বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব খ্যাত মহান শিক্ষক নবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)।
জনমানব শূন্য পাহাড়ে নির্বাসিত অবস্থায় সন্তান প্রতিপালন করা এক দুরূহ কাজ। তদুপরি তৃণলতাহীন পাহাড়ে খাদ্য সংগ্রহ করা আর কোন খাদ্য না পেলে শুধু জমজমের পানি পান করে থাকা কত যে ক্লেশকর তা কল্পনাতীত। এমন একটি প্রতিকূল পরিবেশে বিবি হাজেরা শিশুকে পাহাড়ের ফলমূল খাইয়ে লালন-পালন করেছেন।
কিছুকাল পরে হযরত ইবরাহীম (আঃ) তার স্ত্রী হাজেরা ও সন্তান ইসমাঈলকে নিজ গৃহে নিয়ে আসেন। শিশু পুত্র ইসমাঈল তখনও কৈশোরে পর্দাপণ করেনি। এমতাবস্থায় হযরত ইবরাহীম (আঃ) নির্দেশ পেলেন এমন বস্তু কুরবানী করতে যা তিনি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসেন। কিন্তু কী সে জিনিস ? ইবরাহীম (আঃ) প্রথমত: পশু কুরবানী করলেন কিন্তু কোন লাভ হলো না। আল্লাহর নির্দেশ অব্যাহত রইলো। পরিশেষে ইবরাহীম (আঃ) অনুধাবন করলেন যে তাঁর সব থেকে প্রিয় বস্তু স্বীয় পুত্র ইসমাঈল। আর আল্লাহ সেই পুত্রকেই কুরবানী করতে বলছেন।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও মা হাজেরার পরম আদরের ধন ইসমাঈল। একটি মাত্র পুত্র। এর মাধ্যমেই ইবরাহীম (আঃ) এর বংশ পৃথিবীতে চলমান থাকার কথা। সে আশাটিও তিরোহিত হলো।
মা হাজেরার নিকট কেমন লেগেছিল বিষয়টি ? একটি মাত্র সন্তান। কত কষ্টে একে প্রতিপালন করেছেন। সে সন্তান এখনও বালক। কিন্তু হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর ইচ্ছার প্রতিবাদ করলেন না তিনি। বললেন না যে, এ পুত্রকে তো তুমি পূর্বেই নির্বাসন দিয়েছিলে। কত কষ্টে আমি একে সহায়হীন অবস্থায় প্রতিপালন করেছি। তার ওপর তোমার কিসের অধিকার ? কোন অধিকারে আমার পুত্রের গলায় তোমার প্রভূকে সন্তুষ্ট করার জন্যে ছুরি চালাতে যাচ্ছ ?
তা তো তিনি বললেনই না, বরং স্বেচ্ছায় পুত্রকে সাজিয়ে দিলেন। এ কুরবানী পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর জন্যে যতটা কষ্টকর ছিল, মা হাজেরার জন্যে ছিল তার থেকে লক্ষগুণ বেশী বেদনাদায়ক। কোথা থেকে তিনি এত বিরাট আত্মত্যাগের শক্তি পেলেন ? কেন তিনি স্বামীর সঙ্গে দ্বিমত হলেন না ? যতই হোক আল্লাহর নির্দেশ। তবু তো মা !
বর্তমানে অনেক স্বচ্ছল মুসলিম পরিবারে দেখা যায় স্বামী যদি বিপন্ন গরিব আত্মীয়কে কিছু দান করতে চায় তখন স্ব-স্ত্রীই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। মলিন হয়ে যায় স্ত্রীর সুন্দর মুখখানা। কিন্তু বিবি হাজেরা পুত্র কুরবানীর মত ব্যাপারেও স্বামীর সাথে দ্বিমত পোষণ করলেন না।
পুত্র ইসমাঈলকে যখন পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর প্রতিপালকের নির্দেশ জানালেন তখন তার প্রতিক্রিয়া কি ছিল ? বালক ইসমাঈলও দ্বিধাহীন চিত্তে পিতার কর্তব্য পালনে নিজেকে কুরবানী দিতে এগিয়ে গেল। সে বললো, হে পিতা আপনার প্রভুর নির্দেশ পালনে এ ব্যাপারে আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। ইবরাহীম (আঃ) এবং হাজেরার কুরবানী ছিল পুত্রের প্রাণ আর ইসমাঈলের কুরবানী ছিল তার নিজের জীবন। এ কুরবানী একদিন, দু’দিনের জন্য নয়। সারা জীবনের জন্য; এ কুরবানী যুদ্ধের ময়দানে উত্তেজনার বশে নয়, ঠান্ডা মাথায় ছিলো এ কুরবানীর ইচ্ছা। এটা ছিল মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম কুরবানী।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে চললেন কুরবানী দিতে। আর তিনি যখন চোখ বাধা অবস্থায় পুত্রের গলায় ছুরি চালালেন চোখ খুলে দেখতে পেলেন ভিন্ন ঘটনা। স্ব-পুত্রের স্থলে কুরবানী হয়েছে একটি দুম্বা। আর নিজ পুত্র দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পাশে। আল্লাহর অসীম কৃপা। তিনি বাঁচিয়ে দিলেন ইসমাঈলকে আর কবুল করলেন পিতা ইবরাহীমের কুরবানী।পশু কুরবানীর যে অনুষ্ঠান আমরা পালন করি তার আসল মর্মবানী যদি আমাদের হৃদয়ে না পৌঁছে, বিবি হাজেরা, হযরত ইবরাহীম (আঃ) এবং তাদের পুত্র ইসমাঈল (আঃ) যে অনুভূতি নিয়ে কুরবানীর জন্যে তৈরী হয়েছিলেন, তাদের সেই আদর্শ ও মূল্যবোধ বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা ও দৃঢ় সংকল্পনা নিয়ে যদি এক নিরীহ মূক পশু কুরবানী করা হয় তবে তা হবে পণ্ডশ্রম।
যিলহজ মাস এবং কুরবানী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মুসলিম মূল্যবোধ কেমন হওয়া উচিত। যে পরিবারে পিতা-মাতা-সন্তান সন্ততি মূলবোধের মধ্যে মিল ও সমন্বয় নেই, সে পরিবার ইসলামী আদর্শচ্যুত পরিবার। মুসলিম পরিবারের মূল্যবোধের ভিত্তি হলো আল কুরআন ও সুন্নাহ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর আদর্শেরই তাত্ত্বিক ও বাস্তব রূপ। মুসলিম পরিবারের জন্যে কুরবানী ভোজ উৎসব নয় বরং ত্যাগ, আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধির উৎসব। পবিত্র কুরআনের ভাষায়,
"বলো, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ, সব কিছু বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার জন্য।"
(সূরা-আনয়াম-১৬২)
মুফতি আবুবকর সিদ্দীক আদদাঈ
মহাপরিচালক, দারুল উলূম বাংলাদেশ ও হেড অব শরীয়াহ, যাকাত ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন