ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সমর্থিত নতুন সহায়তা ব্যবস্থা চালুর এক মাস পেরোতে না পেরোতেই ফিলিস্তিনিদের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে জীবন হাতে নিয়ে রাস্তায় নামার বিষয়টি নিত্যদিনের বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। গাজার মানুষ যখন ক্ষুধার তাড়নায় খাবার বিতরণ কেন্দ্রে যাচ্ছেন, তখন সেখানকার পরিস্থিতি পরিণত হচ্ছে প্রাণঘাতী সহিংসতায়। এর বেশিভাগই হচ্ছে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে।
বুধবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ঠিকাদারদের পরিচালিত এবং কাছাকাছি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর পাহারায় থাকা এই বিতরণ কেন্দ্রগুলোর আশপাশে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
অন্যদিকে, জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা উত্তর গাজায় সীমিত পরিমাণ খাবার পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, যে ট্রাকগুলো আটা বা অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে প্রবেশ করছে, তা ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাহাকাররত মানুষের ভিড়ে লুট হয়ে যাচ্ছে।
জাতিসঙ্ঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়-বিষয়ক সংস্থা বা ওসিএইচএর মুখপাত্র ইয়েন্স লারকে এই নতুন সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রগুলোকে ‘মৃত্যুকূপ’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘গাজা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত এলাকা। আমরা যা-ই আনি, সাথে সাথেই মানুষ লুটে নিচ্ছে। এতটাই তাদের নিরাশার মাত্রা।’
নতুন সহায়তা ব্যবস্থা পরিচালনা করছে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ। দক্ষিণ গাজায় হাতে গোনা কয়েকটি বিতরণ কেন্দ্র চালু রয়েছে। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাস ইসরাইল গাজায় কোনো সাহায্য পৌঁছাতে দেয়নি। গত ১৯ মে থেকে কিছুটা শিথিলতা এলে নতুন এই ব্যবস্থা চালু হয়।
এর লক্ষ্য ছিল জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত বিতরণ ব্যবস্থার বিকল্প তৈরি করা। অথচ জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা বলছে, নতুন এই ব্যবস্থায় মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সহায়তা আসছে এবং মানুষকে প্রাণঘাতী ঝুঁকির মধ্যে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হাঁটতে হচ্ছে শুধু একমুঠো খাবারের আশায়। তাদের অভিযোগ, ইসরাইল সাহায্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
বিভিন্ন সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ইসরাইলি সেনারা নতুন সহায়তা কেন্দ্রগুলোর কাছে পৌঁছানো মানুষজনকে তাক করে গুলি চালিয়েছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দাবি, গাজাবাসীরা ‘হুমকির মতো আচরণ’ করলে ইসরাইলি সেনারা সতর্কতামূলক গুলি চালায়। তারা আরো দাবি করেছে, জিএইচএফ পরিচালিত সাইটগুলো প্রয়োজনীয়। কারণ এতে হামাস সাহায্যের সুবিধা নিতে পারছে না। তাদের ভাষ্য, অতীতে হামাস সাহায্যের বড় অংশ নিজেদের হাতে নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিতরণ করত, কিছু কালোবাজারে বিক্রি করত, আর সাধারণ ফিলিস্তিনিদের বঞ্চিত করত।
গত মঙ্গলবার রাফাহ শহরের জিএইচএফ সাইটের কাছে আহতদের চিকিৎসা করেছে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস। তাদের ফিল্ড হাসপাতাল জানিয়েছে, সেদিনের হামলার পর ১৪৯ জন আহত অবস্থায় এসেছিলেন, তাদের মধ্যে ১৬ জনকে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। আরো তিনজন পরে মারা যান। এই সংখ্যাগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দাবি, রাফাহর বিতরণ কেন্দ্র সংক্রান্ত ঘটনার বিষয়ে তারা ‘অবগত নয়’। অন্যদিকে মঙ্গলবার জিএইচএফ দাবি করেছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ভুলভাবে তাদের সাইটের সহিংসতাকে জাতিসঙ্ঘের কনভয়ের আশপাশে হওয়া সহিংসতার সাথে গুলিয়ে ফেলছে।
মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সহায়তা বিতরণ শুরুর পর থেকে রেড ক্রসের ফিল্ড হাসপাতাল অন্তত ২০ বার ‘ম্যাস ক্যাজুয়ালটি প্রোসিডিউর’ চালু করেছে। বৃহস্পতিবার রেড ক্রসের প্রধান মুখপাত্র ক্রিশ্চিয়ান কার্ডন বলেছেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ শক্তিতে নিন্দা জানাই যে এক মাস ধরে প্রতিদিন মানুষ খাবারের জন্য জীবন ঝুঁকিতে ফেলছে এবং আহত ও নিহত হচ্ছে।’
অপরদিকে, সোমবার ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দক্ষিণ কমান্ডের প্রধান মেজর জেনারেল ইয়ানিভ আসোর বলেন, হামাসের হুমকি দূর না হওয়া পর্যন্ত গাজার যুদ্ধ শেষ হবে না। তিনি বলেন, ‘হামাসকে সহ্য করা সম্ভব নয়। হুমকি দূর না করা পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। মূল জটিলতা হচ্ছে যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে। হামাস স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চাইলেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট জানিয়েছেন, হামাসের সামরিক ও শাসন ক্ষমতা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী যুদ্ধবিরতি সম্ভব নয়।
বুধবার ইসরাইলি কর্মকর্তারা উত্তর গাজায় জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ট্রাক প্রবেশের নিয়ম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ বলেছেন, উত্তর গাজায় প্রবেশ করা সাহায্যের ওপর হামাস নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছাতে দিচ্ছে না।তারা সেনাবাহিনীকে ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে একটি পদক্ষেপ পরিকল্পনা’ তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে সাহায্য হামাসের হাতে না যায়।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গাজা-বিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে, মঙ্গলবার ৭১টি ট্রাক খাবার, আটা, ওষুধ ও অন্যান্য সরঞ্জাম গাজায় প্রবেশ করেছে এবং সাহায্য হামাসের কাছে না গিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
গাজায় এখনো দুর্ভিক্ষ চলছে। তবে এক মাসের সহায়তা প্রবাহের পর কিছু এলাকায় খাবার খানিকটা সহজলভ্য হতে শুরু করেছে। জিএইচএফ জানিয়েছে, তারা এ পর্যন্ত আট লাখের বেশি খাবারের বাক্স বিতরণ করেছে, যার মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রায় ৪০ হাজার বাক্স বিতরণ হয়েছে।
সেলিব্রিটি শেফ হোসে আন্দ্রেসের দাতব্য সংস্থা ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন সাত সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর এই সপ্তাহে গাজায় পুনরায় কাজ শুরু করেছে।
তবু জাতিসঙ্ঘ বলছে, গাজা এখনো ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধার’ মুখে রয়েছে। ২০ মাসের বেশি সময় ধরে পর্যাপ্ত সরবরাহ না পাওয়ায় পুষ্টির ঘাটতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গাজার পরিবারগুলো প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খাবারের জন্য বেরোচ্ছে, যেখানে প্রায় প্রতিদিনই সহায়তা কেন্দ্রে ব্যাপক হতাহতের খবর মিলছে। অধিকাংশ পরিবার দিনে এক বেলাও পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না, প্রায়ই প্রাপ্তবয়স্করা খাবার বঞ্চিত থাকছে যাতে শিশু, বয়স্ক আর অসুস্থরা কিছুটা খেতে পারে।’
গাজার কেন্দ্রস্থলের নুসেইরাতের আহমাদ সামিয়ের কাফিনা জানান, তার বড় পরিবারকে খাবার জোগাতে তিনবার সহায়তা কেন্দ্রে গেছেন। তিনি বলেন, রাত ১২টার দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ৪৫ মিনিট হেঁটে সহায়তা কেন্দ্রে যেতে হয়েছে, প্রতিবেশী-আত্মীয়দের নিয়ে গেছেন, কারণ দলবদ্ধে গেলে কিছুটা নিরাপদ বোধ হয়। মাত্র একবারই সামান্য খাবার পেয়েছেন, তাও গুলির মুখে পড়তে হয়েছে। তবুও তার আর কোনো উপায় নেই।
তিনি বলেন, ‘আমি সেখানে মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখেছি। খাবার পাওয়ার আর কোনো উৎস আমাদের নেই।’
সূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ
বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে কাল যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বৈঠক
ইরানের প্রেসিডেন্টের দাবি, ইসরায়েল তাকে ‘হত্যার’ চেষ্টা করেছে
খাদ্যের জন্য মৃত্যুকে উপেক্ষা করে গাজায় ক্ষুধার্ত নারী-পুরুষ-শিশুর লড়াই