এবার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খানের মাধ্যমে প্রকাশিত হলো শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২৯ মে বৃহস্পতিবার রাত ১১ টায় জুলকারনাইন সায়ের তার ভ্যারিফাইড ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত-মোল্লা মাসুদসহ ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেন। সুব্রত বাইন-মোল্লা মাসুদ সেনাবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতারের পরে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। এর আগেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা এবং ভারতে পালাতক আওয়ামী লীগের নেতাদের পরিকল্পনায় এবং অর্থায়নে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ নেতাদের টার্গেট কিলিং করে, হত্যার দায় একে অন্যের উপর চাপানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার নীল নকশার কথা উঠে আসে। জানা যায় বাংলাদেশের গোয়েন্দাসংস্হা ও সেনাবাহিনীর তড়িৎ তৎপরতায় এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সুব্রত-মাসুদ সহ ৪ জন আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবার কথা আলোচিত এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিয়ে অনুসন্ধানী স্টাটাস দিলেন সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের।
তিনি লিখেছেন, "২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে বাংলাদেশের ২৩ জন কুখ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করা হয় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় শীর্ষ ২৩জন অপরাধীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্যে পুরষ্কার ঘোষণা করে। ওই তালিকার প্রথমেই ছিলো ত্রিমোথি সুব্রত বাইন। তার নামে তখন ১লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।"
তিনি লেখেন, "পরবর্তীতে সুব্রত বাইন উপায়ন্তর না দেখে তার সবচেয়ে আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত আরেক পুরস্কার ঘোষিত সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদকে নিয়ে যশোরের পুটখালি সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যায়। কিন্তু সুব্রত প্রায়ই অবৈধভাবে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে যশোরে আসতো চাঁদার টাকা সংগ্রহ করতে, এবং বসবাসের জন্যে যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকায় স্থানীয় লাল্টুর মাধ্যমে একটি বাসাও তখন ভাড়া নেয়। সুব্রতর দ্বিতীয় স্ত্রী বিউটি, সন্তান নূর, বিথি ও রিপন এখানেই অবস্থান করতো, এবং দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে মাসিক চাঁদার টাকা আদায়ের পর আবার সীমান্ত পার হয়ে কোলকাতা চলে যেতো।"
তিনি লিখেছেন, "এরই মাঝে কোলকাতা পুলিশ সুব্রতকে কালিঘাট এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। আটক সুব্রতকে ছাড়াতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভিরুল ইসলাম জয়, এবং তার যোগাযোগ ব্যবহার করে সুব্রতকে জেল থেকে মুক্ত করে। তানভীর জয় ছোটবেলায় দার্জিলিংয়ে পড়াশোনার সুবাদে ভারতীয় স্টাবলিশমেন্টে তার কিছু বন্ধু ছিলো যারা দেশটির সামরিক বাহিনী, পুলিশ প্রশাসন এবং সরকারী বিভিন্ন কার্যালয় কর্মরত ছিলো। "
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাথে এসব সন্ত্রাসীদের মিশন সম্পর্কে তিনি লেখেন, "এই ঘটনার পর জয়, সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে ডেকে পাঠান তৎকালীন কোলকাতার পুলিশ কমিশনার এস. কে. চক্রবর্তী। তখন থেকে মূলত এই তিনজনের ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র এবং সেনা গোয়েন্দা এম আই (Military Intelligence) এর সাথে সম্পর্ক শুরু হয়। জয় শারীরিকভাবে ফিট না হওয়ায় ‘র এর গোয়েন্দা অফিসাররা সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও তাদের সহযোগী গোলাম মর্তুজা বাবু ওরফে মধু বাবুকে ভারতের মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে কমান্ডো প্রশিক্ষণ প্রদান করে নেয়। পরবর্তীতে ‘র এর সিনিয়র কর্মকর্তা এস. মাথুর সুব্রতদের দিল্লি ডেকে নেন এবং বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা ভারতের উলফা, ইউনাইটেড লিবারেশন অফ নাগাল্যান্ড সহ যেসব নিষিদ্ধ সংগঠন আছে সেসব সংগঠনের কিছু নেতাদের ছবি ও ঠিকানা দিয়ে; অস্ত্র অর্থ সহ মিশন কার্যকরী করতে যা যা প্রয়োজন সেসবের ব্যবস্থা করে দেয়।"
তারপর তিনি লেখেন, "২০০৩ সালে সকল প্রস্তুতি নিয়ে সুব্রত ঢাকায় আসে এবং মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাড়ীতে হামলা করে নাগাল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব দাবী করা বম সম্প্রদায়ের এক নেতার স্ত্রী ও তার ৭ বছরের সন্তানকে হত্যা করে। এছাড়াও পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত মোহাম্মদপুর বিহারী ক্যাম্পের মোস্তাকিম কাবাবের মালিক মোস্তাকিমকে গুলি করে হত্যা করে। মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) নামের পাকিস্তান ভিত্তিক একটি সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মোস্তাকিম। এছাড়াও বহুবার উলফার নেতা পরেশ বড়ুয়াকে হত্যার চেষ্টা করে সুব্রত বাইন। ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ অনুরোধে কোলকাতায় থাকা সন্ত্রাসীদের আটকের অভিযান শুরু হয়। তখন কোলকাতার সিআইডি কর্মকর্তা রাজিব কুমার, সুব্রত বাইনকে গ্রেফতারের জন্যে বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সুব্রত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শে ও সহায়তায় আলী মোহাম্মদ নামে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করে প্রথমে সিঙ্গাপুর, এবং পরে চীনে গিয়ে থিতু হয়। সেখানেও সুব্রত বাইন ‘র এর তত্বাবধানেই ছিলো।"
প্রমাণ হিসেবে তিনি তিনটি ছবি যুক্ত করে সেগুলো সম্পর্কে ক্যাপশনে সন্ত্রাসীদের সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার পরিচয় তুলে ধরে।
তিনি লেখেন, "চীনে ‘র খুব বেশি তৎপর না থাকায় সুব্রত বাইন দুবাই পাড়ি জমায়। সেখানে তাকে বিলাসবহুল ভিলায় থাকার ব্যবস্থা করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং তার সহযোগী মোল্লা মাসুদকেও তখন দুবাই পাঠানো হয়। 'র সুব্রত ও মোল্লা মাসুদকে দুবাইতে পলাতক ভারতীয় মোস্ট ওয়ান্টেড টাইগার মেমনের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনের পরামর্শ দেয়, তাদের লক্ষ্য ছিলো টাইগার মেমন এর মাধ্যমে কোনোভাবে মাফিয়া সর্দার দাউদ ইব্রাহীমের নেটওয়ার্কে প্রবেশের। কিন্তু এই মিশনে সফল হতে পারেনি সুব্রত বাইন। পরবর্তীতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র এর পরামর্শে সুব্রত বাইন নেপাল হয়ে ভারতে প্রবেশ করে এবং পরিকল্পনা মাফিক কোলকাতায় তার বালিগঞ্জের বাড়ী থেকে STF (Special Task Force) তাকে গ্রেফতার করে।"
সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদসহ লেদার লিটনের সাথে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের যোগাযোগ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি লেখেন, "২০২৩ এর ফেব্রুয়ারি মাসে কোলকাতা STF সুব্রতকে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে RAB এর কাছে হস্তান্তর করে। তাকে নিয়ে আসা হয় RAB সদর দপ্তরে এবং তার সাথে দেখা করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ও পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম। সুব্রতকে নতুন লক্ষ্য দেয়া হয় এবং বলা হয় এই কাজ সফলভাবে করতে পারলে তাকে পরিবার সহ কানাডায় স্থায়ী ভাবে থাকার বন্দোবস্ত করা হবে। সুব্রত প্রস্তাবে রাজী হলে তাকে কুখ্যাত জিয়াউল আহসানের তত্ত্বাবধায়নে RAB কার্যালয়ের ভেতরেই একটি কক্ষে রাখা হয় এবং তার মেয়ে বিতুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগের ব্যবস্থাও করে দেয়া হয়। এ সময় সুব্রত বাইনকে জিয়াউল আহসানের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা দূরবর্তী টার্গেটকে লক্ষ্য করে আঘাতের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। তাকে স্নাইপার রাইফেল এর ব্যবহার, মুভিং টার্গেটকে গুলি করার আগে বাতাসের গতি, আদ্রতা, দূরত্ব এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে ট্রেনিং দেয়া চলতে থাকে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সুব্রতর সাথে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জিয়াউল আহসান, মনিরুল ইসলাম ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা দেখা করে এবং টার্গেট যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা বলে অবহিত করে। তারা সুব্রতকে পাকিস্তানী পাসপোর্টে লন্ডন পাঠানোর কথা বলে এবং লন্ডনে মিশনটি সম্পন্ন করার জন্যে যা যা সহায়তা লাগবে তা কূটনৈতিক চ্যানেলে প্রদান করা হবে বলে সুব্রতকে নিশ্চিত করে। কাজ হবার পর সুব্রত ও তার পরিবারকে ভারতীয় পাসপোর্টে (আলী মোহাম্মদ নামে) কানাডায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে — এ বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। তারা এটাও জানায় এই কাজের ব্যাপারে সরকারের (তৎকালীন) সর্বোচ্চ পর্যায়ের আগ্রহ আছে এবং সর্বোচ্চ মহলের গ্রীন সিগন্যাল পেলেই পাঠানো হবে এবং তার বেশভূষায় যেন পাকিস্তানী বলে মনে হয এ ব্যাপারেও গুরুত্ব দেয়া হয়।"
এমন লোমহর্ষক পরিকল্পনাভেস্তে যাবার কারণ বলতে গিয়ে তিনি লেখেন, "কিন্তু ২০২৪ এর ৫ই অগাস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে হাসিনা সরকার পতন ও হাসিনায় পালানোর পর জিয়াউল আহসানের নির্দেশে সুব্রতকে তার মেয়ে বিথির কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়, এবং পরবর্তী আদেশের অপেক্ষার কথা জানানো হয়। এর পর থেকেই সুব্রত বাইন প্রকাশ্যে আসা শুরু করে। পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করে ‘র এর সাথে। সুব্রতকে সহায়তা করতে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ফোনসহ পাঠানো হয় মোল্লা মাসুদকে। আর এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর সাথে পলাতক আওয়ামী শীর্ষ নেতাদের যোগাযোগের মাধ্যম হয় নেপালে পলাতক আরেক সন্ত্রাসী লেদার লিটনকে।"
এর আগে ২০২৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের তার ফেসবুকে এবং 'বাংলা আউটলুক' নামে একটি পোর্টালের মাধ্যমে সুব্রত বাইন সম্পর্কে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। দুইদিন আগেই তিনি সুব্রত সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দিলেও সেসময় বিষগুলো সাধারণ মানুষ আমলে নেয়ানি।