সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনের বিরুদ্ধে নতুন করে শুল্ক আরোপ করছে, তখন ভারত এই বিষয়টিকে একটি সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখছে। বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির এই পরিবর্তন ভারতের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কারণ বিশ্ব এখন নতুন উৎপাদন কেন্দ্র খুঁজছে, যেখানে শ্রম সস্তা, পরিকাঠামো শক্তিশালী এবং সরকারি নীতিমালা উৎপাদনবান্ধব। এই প্রেক্ষাপটে, ভারতের সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী উৎসাহ যেমন বাড়ছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরে ভারত চীনের বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চীন, যা বিশ্বজুড়ে 'কারখানা' হিসেবে পরিচিত, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনার মধ্যে সেই অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে শুরু হওয়া এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে চীনের রপ্তানি খাতে বড় ধরনের আঘাত এসেছে, বিশেষ করে ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ বেশ কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছে।
তবে ভারতের জন্য এই পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জের সাথে সাথে সুযোগও তৈরি করেছে। যদিও কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাময়িক ছাড় পেয়েছে, ভারত এখনও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ শ্লোগানকে বাস্তবায়িত করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয় বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন।
ভারতের স্বপ্ন: বিশ্বের ‘নতুন ফ্যাক্টরি’ হওয়া
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি চালু করে দেশের উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করার জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তার লক্ষ্য ছিল ২০২২ সালের মধ্যে ১০ কোটি নতুন চাকরি সৃষ্টি এবং উৎপাদন খাতে জিডিপির অবদান ২৫ শতাংশে উন্নীত করা। এই লক্ষ্য পূরণে সরকার প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করেছে, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে নানা নীতিমালা গ্রহণ করেছে এবং অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিয়েছে।
তবে বাস্তবতায় ভারতের উৎপাদন খাতের অবদান গত দশকে জিডিপিতে ১৫ শতাংশ থেকে কমে ১৩ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যেখানে চীনে এই হার প্রায় ২৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের বড় সমস্যা হচ্ছে কারখানার জন্য দক্ষ কর্মীর অভাব, যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি আমদানির উপর নির্ভরতা, আমলাতন্ত্র, দুর্বল সরবরাহ ব্যবস্থা এবং আইনি জটিলতা।
চীনের রাজত্ব ক্ষুদ্র শিল্পে
ভারতের শিল্প খাতে চীনের আধিপত্য অব্যাহত রয়েছে। হরিয়ানার রাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল নগরীতে নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠলেও, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল বেশিরভাগই আমদানি করতে হয় চীন থেকে। যেমন, ‘লিক্রাফট’ নামক একটি ব্যাটারি তৈরির প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ যন্ত্রপাতি চীন থেকে আসলেও, সেগুলো চালাতে সক্ষম দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে। এইভাবে, ভারত এখনো ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ পণ্য তৈরি করতে হলে চীনের প্রযুক্তি ও উপকরণের উপর নির্ভরশীল।
চ্যালেঞ্জসমূহ
ভারতের শিল্প উদ্যোক্তারা বলেন, প্রকৃত উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে গেলে শুধু অবকাঠামো নয়, প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ, সহজ ব্যবসা পরিবেশ, দ্রুত আইনি নিষ্পত্তি এবং কার্যকর প্রশাসনিক সেবা। বর্তমানে জমির উচ্চমূল্য, প্রকৌশলীর অভাব, ব্যাংক ঋণের সীমাবদ্ধতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা উদ্যোক্তাদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, বিচারব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ভারতের আদালতগুলোতে বর্তমানে ৫ কোটি মামলার স্থগিত রয়েছে, যার কারণে ব্যবসায়িক বিরোধের নিষ্পত্তি পেতে অনেক সময় লেগে যায়।
সফলতার কিছু দৃষ্টান্ত
তবে সবকিছুই নেতিবাচক নয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে এবং ইলেকট্রনিকস ও হ্যান্ডসেট তৈরিতেও কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তামিলনাড়ুর একটি ক্লাস্টার বর্তমানে বিশ্বের ২০ শতাংশ আইফোন উৎপাদন করছে এবং ভবিষ্যতে এর পরিমাণ ৩০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই সফলতা সম্ভব হয়েছে কিছু রাজ্য চীনের শিল্প পার্কগুলোর মডেল অনুসরণ করার মাধ্যমে, যেখানে সরকার ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় উৎপাদনবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ ভারতের জন্য একটি ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’ এনে দিয়েছে। তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আরও গভীর সংস্কার, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং সরকারি নীতিমালার ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। ভারতের প্রবীণ সংসদ সদস্য ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা খান্ডেলওয়াল বলেন, “ইলেকট্রনিকস, গাড়ির যন্ত্রাংশ, কেমিক্যাল এবং টেক্সটাইল শিল্পে ভারত বিশাল অগ্রগতি করতে পারে, তবে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধান করা জরুরি।”
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস
মন্তব্য করুন
আপনার ইমেল প্রকাশ করা হবে না