৮৬'র বেঈমান আসলে কে!! আওয়ামী লীগ-জামায়াত না বিএনপি?
-হামদুল্লাহ আল মেহেদী
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ লেবার পার্টি
সম্প্রতি বিএনপির দফতর সম্পাদক ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জনাব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ১৯৮৬ সালে স্বৈরাচার এরশাদের সাথে আঁতাত করে নির্বাচনে গিয়ে বেইমানি করেছিল। যেহেতু তার এই বক্তব্যে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তাই এ বিষয়ে আমি দেশবাসীকে পরিস্কার ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করছি..
১৯৮৬ সালের ০৭ মে প্রেসিডেন্ট এরশাদের অধীনে ৩য় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-সহ অন্যান্য দল অংশগ্রহণ করেছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দল হয় এবং শেখ হাসিনা প্রথমবারের মত বিরোধীদলীয় নেতা হন। আর জামায়াতে ইসলামী ১০টি আসন নিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদীয় দল গঠন করে। জামায়াতের সংসদীয় দলের নেতা ছিলেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে নির্বাচিত অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। তিনি বর্তমানে জামায়াতের নায়েবে আমীর। ওই নির্বাচনের পর মুজিবুর রহমান পরবর্তীতে আর কখনো নির্বাচিত হতে পারেন নি।
এই পার্লামেন্টে জামায়াতের দুটি বিশেষ অর্জন রয়েছে, যা রাজনৈতিক আলোচনায় সাধারণত উচ্চারিত হয় না।
প্রথমত, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নামাজের বিরতি ছিল না। জামায়াতের দশজন এমপির জোরালো আবেদনে এবং অধিবেশন কক্ষে নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরী নামাজের বিরতি ঘোষনা করেন। সেই থেকে তা অব্যাহত আছে।
দ্বিতীয়ত, এরশাদের পদত্যাগ এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবীতে জামায়াতের এমপিরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে এরশাদ সংসদ ভেঙে দিতে বাধ্য হন। যা পরবর্তীতে স্বৈরাচার এরশাদ পতনের আন্দোলনকে জোরদার করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত ও বিতর্কিত, কিন্তু সুশৃঙ্খল আনুগত্যশীল বিশাল কর্মী বাহিনী সমৃদ্ধ রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক দেশকে দেওয়া উল্লেখযোগ্য তিনটি উপহারের দুটি এখানে উল্লেখ করলাম। সুযোগ পেলে পরবর্তীতে বাকিটা আলোচনা করবো।
উপরোল্লিখিত নির্বাচনে ৭৯ টি দল প্রার্থী দাঁড় করালেও মাত্র ১১ টি দলের প্রার্থী বিজয়ী হয়। তাদের আসনসংখ্যা ছিল নিম্নরূপঃ
১. জাতীয় পার্টি - ১৫৩
২. আওয়ামী লীগ - ৭৫
৩. জামায়াতে ইসলামী - ১০
৪. ন্যাপ (ভাসানী) - ৫
৫. সিপিবি- ৫
৬. মুসলিম লীগ - ৪
৭. জাসদ (রব) - ৪
৮. জাসদ(সিরাজ) - ৩
৯. বাকশাল - ৩
১০. ওয়ার্কার্স পার্টি - ৩
১১. ন্যাপ (মুজাফফর) - ২
এছাড়া অবশিষ্ট ৩৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়।
এবার ছিয়াশির বেঈমান প্রসঙ্গে আসি। 'ছিয়াশির নির্বাচনে স্বৈরাচার এরশাদের সাথে আঁতাত করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বেঈমানি করেছে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত'- এ প্রচারণা তখন থেকে ব্যাপক আলোচনায় আসে এবং চায়ের কাপে ঝড় উঠে। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ও জামায়াতকে এই অপবাদ শুনতে হয়। এখনও মাঝে মাঝে টকশোতে এ নিয়ে আলোচনা হয়। সম্প্রতি রিজভীর বক্তব্য সেই ঐতিহাসিক চলমান বিতর্কেরই একটা অংশ।
অথচ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করলে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আলোচনা চলছিলো যে, তারা যৌথভাবে ৩০০ আসনে নির্বাচন করবে। কিন্তু সমঝোতা না হওয়ায় পরে সিদ্ধান্ত হয়- বিএনপি, আওয়ামী লীগ-সহ সকল বিরোধী দল আলাদাভাবে নির্বাচন করবে।
এর মাসখানেক আগে চট্টগ্রামে শেখ হাসিনা ঘোষনা দিয়েছিলেন- কেউ এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে জাতীয় বেঈমান হবে। পরবর্তীতে সকল বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেই ঘোষণা কার্যত বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু সমঝোতার পরে হঠাৎ বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে আসে এবং আওয়ামী লীগ-জামায়াত নির্বাচনে গেলে তাদেরকে জাতীয় বেঈমান বলতে থাকে!
এ বিষয়ে একসময়ে বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম তাঁর আত্মজীবনী 'জীবনে যা দেখলাম' বইতে উল্লেখ করেছেনঃ "...স্বৈরাচার এরশাদ পতনের লক্ষ্যে আন্দোলনের অংশ হিসেবে সকল বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়। অথচ গভীর রাতে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে আসে এবং আওয়ামী লীগের উপর অপবাদ চাপায়..."
২০০১ সালের ২৬ জানুয়ারী থেকে দৈনিক সংগ্রামে প্রতি শুক্রবার এক কিস্তি করে গোলাম আযমের লেখাটি প্রকাশিত হতে থাকে। পরে বই আকারে বের হয়। কামিয়াব প্রকাশন লিমিটেড থেকে প্রকাশিত বইটির চমৎকার ভূমিকা লেখেন জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ডঃ কাজী দীন মুহাম্মদ ও কবি আল মাহমুদ।
১৯ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেও বিএনপি টেকনিক্যাল কারন দেখিয়ে নির্বাচন থেকে সরে আসা প্রসঙ্গে (জুন ২০০৬-এ প্রকাশিত অধ্যাপক গোলাম আযম রচিত 'জীবনে যা দেখলাম' বইয়ের ষষ্ঠ খন্ডের, অক্টোবর ২০০৮ এ দ্বিতীয় মুদ্রণের ২৫ পৃষ্ঠায়) তিনি উল্লেখ করেনঃ
"মুজাহিদ সাহেব (জামায়াতের তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল) কে.এম. ওবায়েদের (তৎকালীন বিএনপির মহাসচিব) সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করে ঐ কারনটি জেনে নিলেন। বিএনপির প্রথম সারির নয়-দশ জন নেতা প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের মন্ত্রী ছিলেন। সেনাপ্রধান এরশাদ সামরিক শাসন কায়েম করার পর তাদের বেশ কয়েকজনকে কারাবদ্ধ করেন এবং তাদেরকে পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য বলে অন্যায়ভাব অর্ডিন্যান্স জারী করেন। তাদের মধ্যে ওবায়দুর রহমানও একজন।
বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করার উদ্দেশ্যে ঐ অর্ডিন্যান্স বাতিল করে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ওয়াদাও নাকি এরশাদ সাহেব করেছিলেন। ১৯ মার্চ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পর্যন্ত ঐ ওয়াদা পুরণ না করায় বিএনপি সমস্যায় পড়ে গেল। পরের দিন ওয়াদা পূরণের অপেক্ষায় থাকার পর বিএনপি বুঝতে পারলো, এরশাদ সাহেব তাদের ধোঁকা দিয়েছেন। তখন বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিল এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারনে হাসিনার দেওয়া 'জাতীয় বেঈমান' উপাধিটি আওয়ামী লীগের প্রতি সার্থকভাবে প্রয়োগ করল। আসল যে কারনে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারল না, তা তো জনগণের নিকট প্রকাশ করা চলেনা। "
এই লেখায় অত্যন্ত পরিষ্কার যে, দণ্ডিত নেতারা নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ায় নিশ্চিত পরাজয় অথবা ভরাডুবির আশংকাতে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে আসে এবং কৌশলে আওয়ামী লীগকে জাতীয় বেঈমান বানাতে সক্ষম হয়। সুযোগ বুঝে একই অভিযোগে জামায়াতকেও তারা অভিযুক্ত করে এসেছে বিভিন্ন সময়।
সেই ঐতিহাসিক মিথ্যা অপবাদটি অত্যন্ত সুকৌশলে জনাব রিজভী সাহেব এতদিন পরে এখন আবার জামায়াতের উপর কেন প্রয়োগ করছেন, তা আমার বোধগম্য নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে ছাড় দিতে রাজি হয়েছে, কিন্তু আমাদের সঙ্গে ঘাটতি খুবই ছোট- বাণিজ্য উপদেষ্টা
যারা সংস্কার পিছিয়ে দিতে চায় তারাই নির্বাচন পেছাতে চায়: হাসনাত
সানেম'র জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী বিএনপি ৩৯, জামায়াত ২২, এনসিপি ১৬ ভাগ ভোট পাবে
কুমিল্লা অঞ্চলের ১৬ আসনে খেলাফত মজলিসের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম প্রকাশ