অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন সফরকে ঘিরে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। ১০ জুন তিনি যুক্তরাজ্যে পৌঁছাবেন। সফরের অন্যতম উপলক্ষ রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছ থেকে “কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫” গ্রহণ। এই মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা অর্জনের পাশাপাশি তার সফরে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কয়েকটি বৈঠকের সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে ইউনূসের এই সফর শুধু কূটনৈতিক সৌজন্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। সফর ঘিরে একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছে—বাংলাদেশে গণহত্যার অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ।
এই সফরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্যজুড়ে আওয়ামী লীগের প্রবাসী নেতাকর্মীদের মধ্যে নড়েচড়ে বসার আলামত দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ১০ জুনের আগেই যুক্তরাজ্যে পৌঁছাচ্ছেন। লন্ডনে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে পরে ভারতে যাবেন তিনি। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর জয় এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্য কোনো দেশে যাচ্ছেন। সফরের রাজনৈতিক গুরুত্ব এখানেই।
দলীয় সূত্র জানায়, ড. ইউনূসের সফরের দিনই তার বিরুদ্ধে কালো পতাকা প্রদর্শন এবং বিক্ষোভের আয়োজন করা হবে। বিমানবন্দর, হোটেল এবং সভাস্থল—যেখানেই প্রধান উপদেষ্টা যাবেন, সেখানেই থাকবে আওয়ামী লীগের শোডাউন। রাজপরিবারের অনুষ্ঠান বাদে সব জায়গায় এই নিষিদ্ধ দলটি কালো পতাকা দেখাবে বলে জানা গেছে। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য একদিকে ইউনূস সরকারকে আন্তর্জাতিক বার্তা দেওয়া, অন্যদিকে প্রবাসে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক উপস্থিতি জাহির করা।
লন্ডনে বর্তমানে অবস্থান করছেন আওয়ামী লীগের বহু সাবেক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। সাবেক মন্ত্রী আবদুর রহমান, হাছান মাহমুদ, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, শফিকুর রহমান চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নিয়মিত বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন। বিসিবি সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়কে লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে দেখা গেছে। সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামানও বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন এবং নিয়মিত দলীয় তৎপরতায় অংশ নিচ্ছেন।
বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা নিজে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এবং বিক্ষোভের প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। তিনি ভিডিও ও অডিও বার্তার মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীদের উস্কে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব বার্তায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার এবং আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা এখন বিদেশ থেকে সরাসরি দল চালাচ্ছেন।
এদিকে, দলকে পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে দেশ-বিদেশে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। লন্ডনে অবস্থানরত নেতাদের একাংশ জুন-জুলাইয়ের মধ্যে দেশে ফিরে সংগঠিত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একই সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন শহর থেকে নেতাকর্মীদের লন্ডনে জড়ো করার কাজ চূড়ান্ত করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম এখন আওয়ামী লীগের হয়ে ইউরোপজুড়ে লবিং করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তিনি ছয় বছর যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা কূটনৈতিক রীতিনীতির ব্যত্যয়। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাকে এতদিন ওই পদে রাখা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন তিনি বিদেশি কূটনৈতিক মহলে আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরছেন এবং বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন।
সার্বিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং সম্মাননাপ্রাপ্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও, এটি রাজনৈতিক বিরোধিতা ও উত্তেজনার মঞ্চেও পরিণত হতে চলেছে। দেশের অভ্যন্তরে ভেঙে পড়া রাজনৈতিক বলয়ের ছায়া এখন আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রকট হয়ে উঠেছে।