শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তিদের নিখোঁজ করা বা গুমের ঘটনা ছিল একটি কাঠামোবদ্ধ প্রক্রিয়া। গঠিত গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এই গুম প্রক্রিয়াকে ‘তিন স্তরের পিরামিড’ আকারে বর্ণনা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো ধাপে ধাপে অপহরণ, গোপন আটক ও নির্যাতনের কাজ সম্পন্ন করত।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এক যুবকের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ২০১৭ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে র্যাবের হাতে তিনি অপহরণ হন এবং ৭২ দিন গুম অবস্থায় আটক থাকেন। এই সময় তাকে কাপড় ছাড়া ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং বেতের লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। তাঁর শরীরের চামড়া ফেটে রক্ত ঝরেছে, এবং নির্যাতনের চিহ্ন দেড় বছর পরও শরীরে রয়ে গেছে। এমন নির্যাতনের ফলে শারীরিকভাবে বসে থাকা পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
এই প্রতিবেদনে আরও একজন, মাত্র ১৯ বছর বয়সী যুবক, নির্যাতনের যে কৌশল ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেছেন, তা ছিল পূর্বনির্ধারিত। তাকে জোর করে নির্দিষ্ট ‘ফরমেট’ মুখস্থ করিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বলাতে বাধ্য করা হয়। তিনি যখন সত্য বলার চেষ্টা করেন, তখনও ম্যাজিস্ট্রেট তার অভিযোগ গুরুত্ব দেননি এবং উল্টো পুলিশি বক্তব্যই গ্রহণ করেন। নির্যাতনের সময়ে তাকে যেসব কর্মকর্তারা তুলে এনেছিল, তারাই আবার তাকে আদালতে হাজির করত, যেন সত্য বলা না যায়।
এই প্রতিবেদনের পঞ্চম অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে বলা হয়, শেখ হাসিনার আমলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক ব্যক্তিদের হত্যার হুমকি, দীর্ঘমেয়াদি গুম, পরিবারের ওপর হামলার ভয়, এবং একের পর এক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাদেরকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে জোর করা হতো, না দিলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হতো।
প্রতিবেদনে উঠে আসে একটি উদ্বেগজনক চিত্র—যেখানে আদালত ও বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক শত্রু দমন ও রাষ্ট্রীয় অপকর্ম আড়াল করতে ব্যবহৃত হয়েছে। বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা অনেক সময় নির্যাতিতদের স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ দেননি। ফলে গুমের শিকার ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার তো পাননি, উল্টো বছরের পর বছর ধরে মিথ্যা মামলার হয়রানি, ব্যয়, এবং মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়ে পড়েন।
প্রতিবেদনটি দেখায়, ভুক্তভোগীরা শুধু গুমের শিকার হননি, তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় মিথ্যা ফৌজদারি মামলা। এসব মামলার মোকাবিলায় তাদের পরিবারগুলোকে দুই বছরের গড় পারিবারিক আয়ের চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। অনেককে জমি বিক্রি করতে হয়েছে, ঋণ করতে হয়েছে, অথবা দারিদ্র্যের তলানিতে ঠেকেছে।
গুম ও মিথ্যা মামলার কারণে তাদের সামাজিক জীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বারবার আদালতে হাজিরা, বিভিন্ন জেলায় ছুটোছুটি, অব্যাহত হয়রানি—সব মিলিয়ে পুরো প্রক্রিয়া তাদের জীবনের এক স্থায়ী শাস্তিতে পরিণত হয়।
এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনার উল্লেখ করা হয়, যেখানে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক কিশোরকে অপহরণ করে চার বছর গোপনে আটকে রাখা হয়। মুক্তি পাওয়ার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় তাকে তার বাবার সঙ্গে একটি সাইকেল মেরামতের দোকানে পাওয়া যায়। সে আর পড়াশোনায় ফিরে যেতে পারেনি। পরিবারটি আজও দারিদ্র্য ও আইনি হয়রানিতে জর্জরিত।
তদন্ত কমিশনের মতে, এই পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল বিচারব্যবস্থার অপব্যবহার এবং ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করার একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো। আইনের চোখে যে ন্যায়বিচার পাওয়া উচিত, বাস্তবে তা ছিল এক দীর্ঘমেয়াদি শাস্তি, যা একাধিকবার ভুক্তভোগীদের পুরনো ক্ষতকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে।
এই পটভূমিতে কমিশনের উপসংহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—বিচারব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার, নির্যাতিতদের জন্য সহায়তা, এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আইন ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার অপব্যবহার রোধ করা এখন সময়ের দাবি। কমিশন মনে করে, গুম-খুনের আদেশ যারা পালন করেছেন, তাদের নৈতিক ও আইনি বিচক্ষণতার অভাব ছিল। কোনো অন্যায় আদেশ পালনে কেউ বাধ্য নয়, কিন্তু তারা সেটি বুঝতে পারেননি। শেখ হাসিনার পতিত শাসনকাল ছিল বিচারহীনতার এক দীর্ঘমেয়াদি সংস্কৃতি, যা রাষ্ট্রকে নিপীড়নের যন্ত্রে রূপান্তর করেছিল।
উত্তরপ্রদেশে আগ্রাসন চলছে: মসজিদ-মাদ্রাসা টার্গেট করে উচ্ছেদ অভিযান
মাত্র ১৬ দিনে ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ১৮৪ হামলা: এপিসিআর রিপোর্ট
ধর্মীয় বৈষম্যের প্রশ্নে উত্তাল ভারত: মোদীর বিরুদ্ধে ২৮০ মসজিদ-স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ
আয়নাঘরে বন্দীদের কষ্টের গল্পে আবেগাপ্লুত ক্যারি কেনেডি