ভারতের বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পেছনে কেবল অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা নয়, বরং ঢাকার কিছু সাম্প্রতিক ঘটনারও প্রভাব রয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে নয়াদিল্লি। যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব ঘটনার নির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা দেয়নি, তবে বিষয়টি ঘিরে দুই দেশের মধ্যকার চলমান কূটনৈতিক টানাপোড়েন আরও জোরালো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে সাপ্তাহিক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, তাদের বন্দর ও বিমানবন্দরগুলোতে যানজটের কারণে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে সেই সঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাও এই সিদ্ধান্তে ভূমিকা রেখেছে—যার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু জানিয়েছে, এক সাংবাদিক ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এই মন্তব্য করেন জয়সওয়াল। তবে তিনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ডের কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেননি।
এর আগেই ইনডিয়ান এক্সপ্রেস-এর একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর (সেভেন সিস্টার্স) বিষয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের একটি বক্তব্যে দিল্লির মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ওই অঞ্চলে চীনা অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ‘সমর্থনের ইঙ্গিত’ ভারতের দৃষ্টিতে কৌশলগত উদ্বেগের জায়গা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠানো ছিল দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই ব্যবস্থায় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর হয়ে পণ্য পরিবহন সহজতর হতো এবং ভারতেরও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যিক যোগাযোগ সুসংহত হতো। কিন্তু ভারতের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে উভয় দেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্ককে নড়বড়ে করে তুলতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের যে টানাপোড়েন তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু অবস্থান ও বক্তব্য দিল্লিতে অস্বস্তি তৈরি করেছে। একইসঙ্গে ভারতের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রচার দেখা গেছে।
ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত শুধু একটি কৌশলগত পদক্ষেপ নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে নতুন বাস্তবতা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই পরিস্থিতিতে কোনো কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে এখন প্রয়োজন দুই দেশের মধ্যে খোলামেলা সংলাপ ও আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলা।
এরই ধারাবাহিকতায় ৮ এপ্রিল ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (CBIC) এক সার্কুলারের মাধ্যমে বাংলাদেশি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের ঘোষণা দেয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের দিল্লি, মুম্বাই বা কলকাতার বন্দর হয়ে তৃতীয় দেশে রপ্তানি কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হলে পরদিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। তারা জানায়, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনের ফলে ভারতীয় বন্দর ও বিমানবন্দরগুলোতে পণ্যজট, বিলম্ব এবং ব্যাকলগ তৈরি হচ্ছিল, যা তাদের নিজস্ব রপ্তানি কার্যক্রমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেই কারণেই ৮ এপ্রিল ২০২৫ থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করা হয় বলে জানায় নয়াদিল্লি।
তবে এই নিষেধাজ্ঞা নেপাল ও ভুটানগামী বাংলাদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে যদি পণ্য ওই দুই দেশে পাঠানো হয়, তাহলে সেটি ভারতীয় বন্দর ব্যবহার করে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাবে।
বিশ্লেষকদের মতে, মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য এবং ভারতের এই সিদ্ধান্ত একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যদিও ভারতীয় কূটনৈতিক মহল বিষয়টিকে একান্তই ‘অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা’ হিসেবে তুলে ধরছে, বাস্তবতা বলছে কিছুটা ভিন্ন কথা। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনা প্রভাব বৃদ্ধির ইঙ্গিত, বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা—এই সবই মিলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে জটিলতা বাড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো বড় বাজারে দ্রুত পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে। অন্যদিকে, কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে দিল যে, আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে ভারত এখন আগের চেয়ে বেশি সরব ও সংবেদনশীল। এতে বাংলাদেশকেও তার কৌশলগত ভারসাম্য নতুন করে ভাবতে হতে পারে।
এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় পক্ষকে কিছুটা অপ্রস্তুত করে। বৃহস্পতিবার ভারতের সাপ্তাহিক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে ঢাকার এই পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এই বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু এক সরকারি কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, নয়াদিল্লির ধারণা, “ঢাকা সম্ভবত পাকিস্তান থেকে আমদানির পথ উন্মুক্ত করার কৌশলের অংশ হিসেবেই ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।”
এই মন্তব্য স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, ভারত বিশ্বাস করছে বাংলাদেশ তার বাণিজ্যিক কৌশলে কিছুটা কৌশলগত পরিবর্তন আনছে, যা দিল্লির জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে যে শীতলতা তৈরি হয়েছে, তা দিনে দিনে আরও গভীর হচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ইউনূসকে কেন্দ্র করে দিল্লিতে যে অস্বস্তি, তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে ‘ভারতবিরোধী মনোভাব’ এবং ‘অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা’র অভিযোগ এনে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবিও একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে ভারতের পক্ষ থেকে।
এই কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক উত্তেজনার মধ্যেই উভয় দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। একদিকে ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য সুতা আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করছে। এতে দুদেশের দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব এখন এক নতুন মোড় নিচ্ছে, যার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক মতভেদ যদি কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হয়, তাহলে এই অচলাবস্থা উভয় দেশের শিল্প ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সেইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যেও পরিবর্তন আসতে পারে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে আশাবাদী বিশ্লেষকরা, রাজনৈতিক অগ্রগতির সম্ভাবনা
আত্ম উপলব্ধিতে বিএনপি-জামায়াত, ভারতের পুরনো শর্ত ফের আলোচনায়
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক আলোচনা: সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন?
পাকিস্তানের সঙ্গে ১৫ বছর পর আলোচনায় বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
আপনার ইমেল প্রকাশ করা হবে না